জাল নোটের ব্যবসায় সক্রিয় চক্র : কদর বেশি ‘ওয়াশ নোটের’ 

#
news image

দেশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জাল টাকার কারবারিরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এরা সক্রিয় রয়েছে এবং এ চক্রের নজর এবার ছোট নোটে। অভিজাত ধানমণ্ডি এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গোপনে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে চলছে জাল টাকা তৈরির কর্মযজ্ঞ। 
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ পর্যন্ত তিন ধরনের জাল নোটের খোঁজ পেয়েছে। এর মধ্যে কদর বেশি ‘ওয়াশ নোটের’। তাই নজর এবার ছোট নোটের দিকেই পড়েছে কারবারিদের। কেবল ৫০০ কিংবা ১ হাজার টাকা নয়, এবারে ছোট নোট জাল করার দিকেই বেশি ঝুঁঁকেছে চক্রের সদস্যরা। বড় নোটের ক্ষেত্রে অধিক সতর্ক দৃষ্টি থাকায় তুলনামূলক কম নজরে থাকা ১০০ টাকা এবং ৫০ টাকার নোট জাল করার কাজ ইদানিং বেশি হচ্ছে।
বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জাল টাকার কারবারিদের গ্রেফতার করলেও জামিনে বেরিয়েই পুরনো কাজে ফিরে যাচ্ছে। বারবার গ্রেফতার করা হলেও জাল নোট প্রতিরোধের সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় সহজেই জামিনে মুক্ত হচ্ছে চক্রের সদস্যরা।
দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র জাল টাকা তৈরি করে আসছে এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত শনিবার রাতে (২২ অক্টোবর) একযোগে রাজধানীর চকবাজার, সিরাজগঞ্জ ও খুলনায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে জাল টাকা তৈরি চক্রের অন্যতম হোতা মাউন হোসেন সাব্বির ও তার সহযোগীসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের জাল বা নকল নোট উদ্ধার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে জাল নোট তৈরির বিপুল সরঞ্জামাদিও উদ্ধার করা হয়েছে।
ফেসবুক, মেসেঞ্জারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জাল নোটের ব্যবসা করতো এই চক্রটি বলে জানায় র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। রবিবার রাজধানী কাওরানবাজার র‌্যাব মিডিয়া সেলে গ্রেফতারকৃতদেরসহ এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব মুখমাত্র মঈন আরও বলেন, গ্রেফতারদের নামে জাল টাকা তৈরির অভিযোগে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। তারা গত ১২ বছর ধরে জাল টাকা তৈরি এবং বিক্রির কারবার করে আসছিল। এদের মধ্যে গ্রেফতার জাল নোট চক্রের অন্যতম হোতা সাব্বিরের দেশে ১৫টি জাল টাকার মার্কেটিং কোম্পানি রয়েছে। 
তারা এক লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোটের বান্ডেল মান ভেদে ১০ থেকে ১৫ হাজার অরিজিনাল টাকায় কিনে নিত এবং মাসে তারা ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকার জাল নোট তৈরি করে আসছিল বলেন এই কর্মকর্তা। তিনি জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, তারা যোগসাজশের মাধ্যমে প্রায় এক বছর ধরে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট তৈরি করে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতেন। 
এ ছাড়া এই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং দোকান, মাছের আড়তসহ জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় জাল নোট ব্যবহার করতেন। চক্রটির অন্যতম হোতা সাব্বিরের সঙ্গে আরও ১৫-২০ জন সদস্য জড়িত রয়েছেন বলে জানা যায়। তারা কম সময়ে অল্প পুঁজিতে ধনী হওয়ার জন্য এভাবে প্রতারণা করেছেন। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে এ ধরনের জাল টাকা তৈরি ও ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়। 
খন্দকার মঈন বলেন, সাব্বিরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পেজে পরিচালিত ‘জাল টাকা প্রতারক চক্রবিরোধী পোস্ট’ নামের একটি গ্রুপের মাধ্যমে কাজ চালাতেন। তারা প্রথমে মেসেঞ্জারে এক্সম্যান নামের একটি গ্রুপ খুলে জাল টাকা তৈরি, ব্যবসার বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করতেন। এ গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে শিহাব কাজ করতেন। শিহাবের মাধ্যমে পারভেজ ও তারেকের সঙ্গে মাউনের পরিচয় হয়। পরবর্তীকালে মাউন ইউটিউব, ফেসবুক ও গুগল থেকে বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান অর্জন করে জাল নোট তৈরির জন্য সরঞ্জাম কেনেন এবং জাল নোট সরবরাহ শুরু করেন।
র‌্যাব গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ঢাকায় জাল নোট তৈরির কত চক্র কাজ করছে তার হিসাব নাই। তবে জাল নোট তৈরিতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কারবারিরা যুক্ত হচ্ছে। অনেকেই কাজ শেখার জন্য যুক্ত হয় বড় কারবারিদের সঙ্গে। পরে কৌশল আয়ত্ত করে তারা নিজেই নোট তৈরির কারখানা খুলে বসে। 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানীসহ সারা দেশে অর্ধশতাধিক গ্রুপ জাল টাকা তৈরি এবং বিপণনে জড়িত। ভেজাল টাকা নিখুঁত করার ব্যাপারে প্রতিযোগিতাও চলে। যেই চক্রের টাকা যত নিখুঁত, দামও তত বেশি। জাল টাকা তৈরি ও বিপণনের কাজে জড়িত চক্রের সদস্যরা ৩ ভাগে বিভক্ত। একটি গ্রুপ অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি করে, অপর গ্রুপ টাকার বান্ডিল পৌঁছে দেয়, আরেক গ্রুপ এসব টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়।
সূত্র বলছে, বাজারে তিন ধরনের জাল নোটের অস্তিত্ব মিলেছে। এর মধ্যে ‘ওয়াশ নোট’ নামের জাল নোটের কদর সবচেয়ে বেশি। 
জানা গেছে, আসল ১০০ টাকার নোট দিয়ে ‘ওয়াশ নোট’ নামের ৫০০ টাকার জাল নোট তৈরি হচ্ছে শুধুই প্রিন্টারের ‘কল্যাণে’। ১০০ টাকার আসল নোটে প্রথমে রাসায়নিক দিয়ে সাদা করা হয় এবং পরে প্রিন্টারের মাধ্যমে ৫০০ টাকার জাল নোট বের করা হয়। আবার, ১০ টাকার নোট এবং ৫০ টাকার নোট সমান মাপের হওয়ায় ১০ টাকার নোটে কেমিক্যাল দিয়ে সাদা করে ৫০ টাকার ছাপ মারা হচ্ছে। 
জাল নোট প্রতিরোধে কাজ করা বিভিন্ন সূত্র মতে, ১০০ এবং ৫০০ টাকার নোট একই মাপের করাটাই ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ঐতিহাসিক ভুল।
তাদের মতে, এক লাখ টাকা মূল্যমানের এই ‘ওয়াশ নোট’ বিক্রি হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। এছাড়া আর্ট পেপারে তৈরি জাল ১০০টি এক হাজার টাকার নোট বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তৃতীয়ত, খসখসে কাগজে তৈরি ১ লাখ টাকা মূল্যমানের ১ হাজার টাকার জাল নোট ২৫-৩০ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়।
পুলিশ ও র‌্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ১ লাখ জাল টাকা তৈরি করতে খরচ হয় সাত থেকে দশ হাজার টাকা। পরে জালাট প্রস্তুতকারীরা বাজারে পাইকারি ক্রেতা বা ডিলারের কাছে ১ লাখ জাল টাকা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। পাইকারি বিক্রেতা প্রথম খুচরা ক্রেতার কাছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, প্রথম খুচরা বিক্রেতা দ্বিতীয় খুচরা ক্রেতার কাছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। সবশেষে দ্বিতীয় খুচরা বিক্রেতা মাঠ পর্যায়ে সেই টাকা আসল ১ লাখ টাকায় বিক্রি করে থাকে। অর্থাৎ চার-পাঁচ হাত বদল হয়ে জাল টাকা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের হাতে। প্রতিটি চক্রের রয়েছে ২০ থেকে ২৫ সদস্য। তারা বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কাজ করে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, জাল নোটের কারবার একটি প্রতারণামূলক ব্যবসা। ১ লাখ জাল টাকা ছড়িয়ে দিতে পারলে চক্রের পাইকারি ডিলাররা অন্তত আসল ২০ হাজার টাকা পায়। নকল টাকা তৈরির ক্ষেত্রে জাল নোট চক্র বর্তমানে অনেক উন্নত কাগজ, সরঞ্জাম ব্যবহার করছে। প্রিন্টিং কাজে যারা অভিজ্ঞ তাদের চক্রে ভেড়াচ্ছে। চক্রগুলো আগে বড় নোট জাল করত, এখন ছোট নোটে অর্থাৎ ১০০ ও ৫০ টাকায় চলে গেছে। এসব বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি করা হচ্ছে।
অপরদিকে জাল নোট তৈরির চক্রের বিরুদ্ধে কাজ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কমিটি বলছে, জাল টাকা দেশের অর্থনীতির জন্য বিরাট হুমকি। দেশে যে কোন উৎসবের সময় জাল নোটের বিস্তার বেশি ঘটে বলে প্রবাদ তৈরি হয়েছে ‘জাল টাকা উৎসবের কাঁটা’।
তারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকার সুযোগ নিয়ে বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে জাল নোট চক্রের সক্রিয় সদস্যরা। এ জন্য দ্রুত জাল নোট প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের পাশাপাশি অর্থের নিরাপত্তা (নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য) আরও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু এ বিষয়ে মূল কর্তৃপক্ষ, তাই জাল টাকা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে নানা সুপারিশ করা হয়েছে। গত দুই-তিন বছর ধরে তারাও চেষ্টা করছেন। 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে দেশের কাগুজে মুদ্রার নিরাপত্তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও ভাবতে হবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে মেশিন ছাড়া আসল নকল বোঝার সুযোগ কম। এ মেশিন ছাড়াও কি দেখে নকল টাকা চেনা যাবে সে বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে গণমাধ্যমে।
জাল টাকা বিস্তার ঠেকাতে তিনটি প্রস্তাবের কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, জাল টাকা বিষয়ে সবার সচেতন হতে হবে। মূলত ৫০০, ১০০ এবং ৫০ টাকার নোটে জাল পাওয়া যায়। সে কারণে এসব নোট লেনদেনে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এসব নোটে যে সব সিকিউরিটি চিহ্নিত থাকে সেগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখে লেনদেন করতে হবে। দুই, যেসব জায়গায় বড় বড় ট্রানজিট হয় সেসব জায়গায় লেনদেনে জালনোট শনাক্তকরণ মেশিনের ব্যবহারে করতে হবে। তিন, বড় বড় ব্যবসায়ীরা যাতে বড় ধরনের লেনদেন নগদ টাকায় না করে। আর যদি একান্ত করতেই হয় সে ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোনোভাবে জাল টাকা ঢুকে না পড়ে। 
তিনি বলেন, ‘আমার সময়ে আমি জাল টাকার কারবারিদের ব্যাপারে গুরু দণ্ডের সুপারিশ করেছিলাম। সেভাবে কাজ অনেকটা এগিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি।’

 

এসএম শামসুজ্জোহা

২৭ অক্টোবর, ২০২২,  12:01 AM

news image

দেশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জাল টাকার কারবারিরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এরা সক্রিয় রয়েছে এবং এ চক্রের নজর এবার ছোট নোটে। অভিজাত ধানমণ্ডি এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গোপনে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে চলছে জাল টাকা তৈরির কর্মযজ্ঞ। 
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ পর্যন্ত তিন ধরনের জাল নোটের খোঁজ পেয়েছে। এর মধ্যে কদর বেশি ‘ওয়াশ নোটের’। তাই নজর এবার ছোট নোটের দিকেই পড়েছে কারবারিদের। কেবল ৫০০ কিংবা ১ হাজার টাকা নয়, এবারে ছোট নোট জাল করার দিকেই বেশি ঝুঁঁকেছে চক্রের সদস্যরা। বড় নোটের ক্ষেত্রে অধিক সতর্ক দৃষ্টি থাকায় তুলনামূলক কম নজরে থাকা ১০০ টাকা এবং ৫০ টাকার নোট জাল করার কাজ ইদানিং বেশি হচ্ছে।
বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জাল টাকার কারবারিদের গ্রেফতার করলেও জামিনে বেরিয়েই পুরনো কাজে ফিরে যাচ্ছে। বারবার গ্রেফতার করা হলেও জাল নোট প্রতিরোধের সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় সহজেই জামিনে মুক্ত হচ্ছে চক্রের সদস্যরা।
দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র জাল টাকা তৈরি করে আসছে এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত শনিবার রাতে (২২ অক্টোবর) একযোগে রাজধানীর চকবাজার, সিরাজগঞ্জ ও খুলনায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে জাল টাকা তৈরি চক্রের অন্যতম হোতা মাউন হোসেন সাব্বির ও তার সহযোগীসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের জাল বা নকল নোট উদ্ধার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে জাল নোট তৈরির বিপুল সরঞ্জামাদিও উদ্ধার করা হয়েছে।
ফেসবুক, মেসেঞ্জারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জাল নোটের ব্যবসা করতো এই চক্রটি বলে জানায় র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। রবিবার রাজধানী কাওরানবাজার র‌্যাব মিডিয়া সেলে গ্রেফতারকৃতদেরসহ এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব মুখমাত্র মঈন আরও বলেন, গ্রেফতারদের নামে জাল টাকা তৈরির অভিযোগে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। তারা গত ১২ বছর ধরে জাল টাকা তৈরি এবং বিক্রির কারবার করে আসছিল। এদের মধ্যে গ্রেফতার জাল নোট চক্রের অন্যতম হোতা সাব্বিরের দেশে ১৫টি জাল টাকার মার্কেটিং কোম্পানি রয়েছে। 
তারা এক লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোটের বান্ডেল মান ভেদে ১০ থেকে ১৫ হাজার অরিজিনাল টাকায় কিনে নিত এবং মাসে তারা ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকার জাল নোট তৈরি করে আসছিল বলেন এই কর্মকর্তা। তিনি জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, তারা যোগসাজশের মাধ্যমে প্রায় এক বছর ধরে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট তৈরি করে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতেন। 
এ ছাড়া এই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং দোকান, মাছের আড়তসহ জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় জাল নোট ব্যবহার করতেন। চক্রটির অন্যতম হোতা সাব্বিরের সঙ্গে আরও ১৫-২০ জন সদস্য জড়িত রয়েছেন বলে জানা যায়। তারা কম সময়ে অল্প পুঁজিতে ধনী হওয়ার জন্য এভাবে প্রতারণা করেছেন। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে এ ধরনের জাল টাকা তৈরি ও ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়। 
খন্দকার মঈন বলেন, সাব্বিরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পেজে পরিচালিত ‘জাল টাকা প্রতারক চক্রবিরোধী পোস্ট’ নামের একটি গ্রুপের মাধ্যমে কাজ চালাতেন। তারা প্রথমে মেসেঞ্জারে এক্সম্যান নামের একটি গ্রুপ খুলে জাল টাকা তৈরি, ব্যবসার বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করতেন। এ গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে শিহাব কাজ করতেন। শিহাবের মাধ্যমে পারভেজ ও তারেকের সঙ্গে মাউনের পরিচয় হয়। পরবর্তীকালে মাউন ইউটিউব, ফেসবুক ও গুগল থেকে বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান অর্জন করে জাল নোট তৈরির জন্য সরঞ্জাম কেনেন এবং জাল নোট সরবরাহ শুরু করেন।
র‌্যাব গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ঢাকায় জাল নোট তৈরির কত চক্র কাজ করছে তার হিসাব নাই। তবে জাল নোট তৈরিতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কারবারিরা যুক্ত হচ্ছে। অনেকেই কাজ শেখার জন্য যুক্ত হয় বড় কারবারিদের সঙ্গে। পরে কৌশল আয়ত্ত করে তারা নিজেই নোট তৈরির কারখানা খুলে বসে। 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানীসহ সারা দেশে অর্ধশতাধিক গ্রুপ জাল টাকা তৈরি এবং বিপণনে জড়িত। ভেজাল টাকা নিখুঁত করার ব্যাপারে প্রতিযোগিতাও চলে। যেই চক্রের টাকা যত নিখুঁত, দামও তত বেশি। জাল টাকা তৈরি ও বিপণনের কাজে জড়িত চক্রের সদস্যরা ৩ ভাগে বিভক্ত। একটি গ্রুপ অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি করে, অপর গ্রুপ টাকার বান্ডিল পৌঁছে দেয়, আরেক গ্রুপ এসব টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়।
সূত্র বলছে, বাজারে তিন ধরনের জাল নোটের অস্তিত্ব মিলেছে। এর মধ্যে ‘ওয়াশ নোট’ নামের জাল নোটের কদর সবচেয়ে বেশি। 
জানা গেছে, আসল ১০০ টাকার নোট দিয়ে ‘ওয়াশ নোট’ নামের ৫০০ টাকার জাল নোট তৈরি হচ্ছে শুধুই প্রিন্টারের ‘কল্যাণে’। ১০০ টাকার আসল নোটে প্রথমে রাসায়নিক দিয়ে সাদা করা হয় এবং পরে প্রিন্টারের মাধ্যমে ৫০০ টাকার জাল নোট বের করা হয়। আবার, ১০ টাকার নোট এবং ৫০ টাকার নোট সমান মাপের হওয়ায় ১০ টাকার নোটে কেমিক্যাল দিয়ে সাদা করে ৫০ টাকার ছাপ মারা হচ্ছে। 
জাল নোট প্রতিরোধে কাজ করা বিভিন্ন সূত্র মতে, ১০০ এবং ৫০০ টাকার নোট একই মাপের করাটাই ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ঐতিহাসিক ভুল।
তাদের মতে, এক লাখ টাকা মূল্যমানের এই ‘ওয়াশ নোট’ বিক্রি হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। এছাড়া আর্ট পেপারে তৈরি জাল ১০০টি এক হাজার টাকার নোট বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তৃতীয়ত, খসখসে কাগজে তৈরি ১ লাখ টাকা মূল্যমানের ১ হাজার টাকার জাল নোট ২৫-৩০ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়।
পুলিশ ও র‌্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ১ লাখ জাল টাকা তৈরি করতে খরচ হয় সাত থেকে দশ হাজার টাকা। পরে জালাট প্রস্তুতকারীরা বাজারে পাইকারি ক্রেতা বা ডিলারের কাছে ১ লাখ জাল টাকা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। পাইকারি বিক্রেতা প্রথম খুচরা ক্রেতার কাছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, প্রথম খুচরা বিক্রেতা দ্বিতীয় খুচরা ক্রেতার কাছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। সবশেষে দ্বিতীয় খুচরা বিক্রেতা মাঠ পর্যায়ে সেই টাকা আসল ১ লাখ টাকায় বিক্রি করে থাকে। অর্থাৎ চার-পাঁচ হাত বদল হয়ে জাল টাকা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের হাতে। প্রতিটি চক্রের রয়েছে ২০ থেকে ২৫ সদস্য। তারা বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কাজ করে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, জাল নোটের কারবার একটি প্রতারণামূলক ব্যবসা। ১ লাখ জাল টাকা ছড়িয়ে দিতে পারলে চক্রের পাইকারি ডিলাররা অন্তত আসল ২০ হাজার টাকা পায়। নকল টাকা তৈরির ক্ষেত্রে জাল নোট চক্র বর্তমানে অনেক উন্নত কাগজ, সরঞ্জাম ব্যবহার করছে। প্রিন্টিং কাজে যারা অভিজ্ঞ তাদের চক্রে ভেড়াচ্ছে। চক্রগুলো আগে বড় নোট জাল করত, এখন ছোট নোটে অর্থাৎ ১০০ ও ৫০ টাকায় চলে গেছে। এসব বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি করা হচ্ছে।
অপরদিকে জাল নোট তৈরির চক্রের বিরুদ্ধে কাজ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কমিটি বলছে, জাল টাকা দেশের অর্থনীতির জন্য বিরাট হুমকি। দেশে যে কোন উৎসবের সময় জাল নোটের বিস্তার বেশি ঘটে বলে প্রবাদ তৈরি হয়েছে ‘জাল টাকা উৎসবের কাঁটা’।
তারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকার সুযোগ নিয়ে বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে জাল নোট চক্রের সক্রিয় সদস্যরা। এ জন্য দ্রুত জাল নোট প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের পাশাপাশি অর্থের নিরাপত্তা (নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য) আরও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু এ বিষয়ে মূল কর্তৃপক্ষ, তাই জাল টাকা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে নানা সুপারিশ করা হয়েছে। গত দুই-তিন বছর ধরে তারাও চেষ্টা করছেন। 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে দেশের কাগুজে মুদ্রার নিরাপত্তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও ভাবতে হবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে মেশিন ছাড়া আসল নকল বোঝার সুযোগ কম। এ মেশিন ছাড়াও কি দেখে নকল টাকা চেনা যাবে সে বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে গণমাধ্যমে।
জাল টাকা বিস্তার ঠেকাতে তিনটি প্রস্তাবের কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, জাল টাকা বিষয়ে সবার সচেতন হতে হবে। মূলত ৫০০, ১০০ এবং ৫০ টাকার নোটে জাল পাওয়া যায়। সে কারণে এসব নোট লেনদেনে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এসব নোটে যে সব সিকিউরিটি চিহ্নিত থাকে সেগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখে লেনদেন করতে হবে। দুই, যেসব জায়গায় বড় বড় ট্রানজিট হয় সেসব জায়গায় লেনদেনে জালনোট শনাক্তকরণ মেশিনের ব্যবহারে করতে হবে। তিন, বড় বড় ব্যবসায়ীরা যাতে বড় ধরনের লেনদেন নগদ টাকায় না করে। আর যদি একান্ত করতেই হয় সে ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোনোভাবে জাল টাকা ঢুকে না পড়ে। 
তিনি বলেন, ‘আমার সময়ে আমি জাল টাকার কারবারিদের ব্যাপারে গুরু দণ্ডের সুপারিশ করেছিলাম। সেভাবে কাজ অনেকটা এগিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি।’