পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণঃ অর্থের বিনিময়ে 'কেএনএফ'
এসএম শামসুজ্জোহা
২৩ অক্টোবর, ২০২২, 8:38 PM
পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণঃ অর্থের বিনিময়ে 'কেএনএফ'
জঙ্গিবাদ সারাবিশ্বের জন্য এখন একটি বড় আতঙ্ক। পাহাড়ে একাধিক গোপন আস্তানায় সম্প্রতি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নতুন করে কথিত হিজরতের নামে ঘরছাড়া তরুণরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন দেশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
এসব আস্তানায় হিজরত করা তরুণদের ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফগানফেরত বাংলাদেশি মুজাহিদরাই গোপনে জঙ্গি কর্মকান্ড অব্যাহত রাখার তথ্য পেয়েছে বলে দাবী করছে দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। আফগানফেরত এসব যোদ্ধাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
জামায়াত-শিবিরের এক শ্রেণির উগ্রবাদী গোষ্ঠী নেপথ্যে থেকে নানাভাবে তাদের সহায়তা দিচ্ছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দারা। তাদের তথ্য মতে, জামায়াত-শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতি যখন বন্ধপ্রায় তখন আফগানফেরত এসব যোদ্ধা ইসলামের নামে ধর্মভীরু মানুষের ভেতর ছড়িয়ে দিচ্ছে জঙ্গি মনোভাব। তবে জঙ্গিদের আগের মতো জানান দেওয়ার সুযোগ নেই বলে দেশের মাঠ পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জোর দিয়ে বলছেন।
সম্প্রতি বান্দরবান ও রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তাদের মধ্যে ৭ জন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্য এবং ৩ জন পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সদস্য। গ্রেফতারকালে তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। আফগানফেরত বাংলাদেশি মুজাহিদরাই হিজরত করা তরুণদের অস্ত্র ও যুদ্ধক্ষেত্র প্রশিক্ষণে পাহাড়ে ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিতো বলে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে প্রাথমিক জিঙ্গাসাবাদে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গ্রফতারকৃত ৩ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় তারা স্থানীয় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের সামরিক শাখা কেএনএ’র সক্রিয় সদস্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অস্ত্র চালনাসহ সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গোপনে পরিচালনার জন্য বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম এলাকাকে বেছে নেয় জঙ্গিরা। এজন্য তারা স্থানীয় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ)-এর সহায়তা গ্রহণ করার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করতো। তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ করে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, কেএনফের প্রতিষ্ঠাতা নাথাং বমের সঙ্গে ২০২১ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আমিরের সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং পার্বত্য অঞ্চলের কেএনএফের ছত্রচ্ছায়ায় জামাতুল আনসারের সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য তারা চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা এবং কেএনএফের সব সদস্যের খাবার খরচ বহন করা হতো। এখনো ৫০ জনের বেশি জঙ্গি পাহাড়ে আত্মগোপনে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবাইকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এ ব্যাপারে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, দেশে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শীর্ষ নেতাদের ধরতে পাহাড়ে অভিযান শুরু হয়। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নতুন করে কথিত হিজরতের নামে ঘরছাড়া তরুণরা জামাতুল আনসারের হয়ে পাহাড়ি এলাকার আস্তানায় আশ্রয় নেয়। এসব আস্তানায় হিজরত করা তরুণদের ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফগানফেরত বাংলাদেশি মুজাহিদরাই গোপনে জঙ্গি কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় হিজরতের নামে সম্প্রতি বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ১৯ জেলার ৫৫ তরুণের তালিকা প্রকাশ করে র্যাব। তাদের মধ্যে ৩৮ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি জানা যায়, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ে বাড়িছাড়া কিছু তরুণ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। নতুন এ জঙ্গি সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে আফগান ফেরত মুজাহিদরা আবার পাহাড়ী বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠন কেএনএফ। মঈন বলেন, ‘জঙ্গি সংগঠনগুলোর আগের সেই শক্তিমত্তা নেই। মাঝে-মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করে থাকে। আফগানফেরত কিছু কথিত মুজাহিদ এসব জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেপথ্যে কাজ করছে।’
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন কারাভোগের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে শতাধিক আফগানফেরত যোদ্ধা জামিনে মুক্তি পেয়ে পলাতক জীবন-যাপন করছেন। এদের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা এলাকার বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসায় ছদ্মনামে শিক্ষাদানের আড়ালে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন বলে জানিয়েছে গোয়েন্দাদের একটি সূত্র। আবার তাদের কেউ কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে বলেও গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি কিংবা ব্যবসাও করছেন তারা।
এদের মধ্যে বর্তমানে ২৮ জন এখনো পলাতক জীবন-যাপন করছে। তারা হল- কক্সবাজারের আবুল কাশেম, মানিকগঞ্জের আবুল খায়ের মসরু, নরসিংদীর মোস্তফা কামাল, চকরিয়ার রেজাউল করিম, হাফেজ সিরাজুল করিম, পটুয়াখালীর ইব্রাহিম খলিলউল্লাহ, গোপালগঞ্জের বোরহান উদ্দিন মামুন, আবুল হোসেন ওরফে আবুল হাসেম, মিরসরাইয়ের দিদারুল আলম, ফেনীর জসিম উদ্দিন, আবদুল আজিজ, গিয়াস, দিনাজপুরের রাশিদুল ইসলাম, ময়মনসিংহের আবুল কাশেম, চট্টগ্রামের আবদুল আজিজ ওরফে হালিম ওরফে সেলিম নুরুল আলম, বাহাউদ্দিন ওরফে বাগার উদ্দিন, শামসুল ইসলাম, চাঁদপুরের মাওলানা আবদুস সোবহান, আবু জিহাদ, হবিগঞ্জের নুরুল হক, মাওলানা আবু তাহের, কিশোরগঞ্জের মুহিবুর রহমান, শরিয়ত উল্লাহ, দিনাজপুরের রাশেদুল ইসলাম, যশোরের শেখ আনিছুর রহমান, রাজবাড়ীর হাফেজ আলী, ইয়াছ আহম্মেদ, খুলনার হাফেজ আবু তাহের।
গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) হারুন অর রশিদ বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের প্রশিক্ষণ শিবিরে মোট প্রশিক্ষণার্থী অর্ধশতাধিক। আফগান ফেরত মুজাহিদ আনিসুর রহমান মাহমুদের নেতৃত্বে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামের উগ্রবাদী সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া এই সংগঠনে ছয় জন শূরা সদস্য রয়েছে, যারা দাওয়াতি, সামরিক, অর্থ, মিডিয়া ও উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছে। শূরা সদস্য আবদুল্লাহ মাইমুন দাওয়াতি শাখার প্রধান, মাসকুর রহমান সামরিক শাখার প্রধান, মারুফ আহমেদ সামরিক শাখার দ্বিতীয় ব্যক্তি, মোশারফ হোসেন অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান, শামীম মাহফুজ প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং ভোলার শায়েখ আলেম বিভাগের প্রধান হিসেবে সংগঠনটিতে দায়িত্ব পালন করছে।
তিনি বলেন, এদের ধরতে মাঠে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। পাশাপাশি দেশব্যাপী ব্যাপক গোয়েন্দা নজরদারিও অব্যাহত আছে। ভয়ংকর এসব জঙ্গিদের গ্রেফতার করতে সবগুলো সংস্থা কাজ করছে। ‘এ কথাও সত্য যে, তারা যত ভয়ংকরই হোক না কেন, আর আগের মতো সুযোগ পাবে না। কেননা তাদের নেটওয়ার্ক গোয়েন্দাদের নজরদারিতে আছে।’
র্যাবের জঙ্গিবিরোধী ইন্টেলিজেন্সের একটি সূত্র জানায়, গণতন্ত্র ও মানুষের শত্রু হিসেবে জঙ্গিবাদকে দমন করার জন্য প্রত্যেকটি দেশ যেমন সচেষ্ট হয়েছে, তেমনই জাতিসংঘ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলেছে, আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের শিকড় অনেক ভেতরে চলে গেছে। দেশি-বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থায়ন ও সরবরাহ এদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সংগঠিত হতে সহায়তা করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার যুক্ত রিপোর্টে ১০টি এনজিও এবং ইসলামী সাহায্য সংস্থাকে জঙ্গি অর্থায়ন ও সহায়তায় লিপ্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। এসব টাকা জঙ্গি তৎপরতার কাজে ব্যয় করা হয় বলে গোয়েন্দারা জানিয়েছে।
র্যাব গোয়েন্দা বিভাগের সূত্র মতে, স্লিপার সেল জঙ্গি ভাষায় তাদেরকে ‘মুজাহিদ’ বলা হয়। এরা সবসময় ছদ্মবেশ ধারণ করে চলাফেরা করে থাকে। এরা প্রথমে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের বাছাই করে হত্যার পরিকল্পনা করে। স্লিপার সেলের একজন সদস্যের সঙ্গে অন্য সদস্যের কোন রকম পরিচয় থাকে না। সে মোতাবেক সক্রিয় জঙ্গি নির্দেশনায় সারা দেশে জঙ্গিদের সমন্বয়ে শতাধিক স্লিপার সেল গজিয়ে উঠেছে। এসব সেলের সদস্যদের শিক্ষা-দীক্ষা না থাকলেও তারা যেমন সাহসী তেমনই মানুষ হত্যায় (কতল) বেশ পারদর্শী। প্রতিটি সেলে তিন থেকে চারজন সদস্য থাকে। আফগান ফেরত প্রশিক্ষিত যোদ্ধারাই জেএমবি, হুজি এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গি সদস্যরাই সেলগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে।
বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি দমনে সরকারের বিশেষ টিম মাঠ পর্যায় কাজ করছে এবং খুব শীঘ্রই দেশ থেকে জঙ্গিদের মূলউৎপাটন করা হবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন। তিনি বলেন, তথাকথিত হিজরতের নামে তরুণরা বাড়ি থেকে বের হয়েছেন বা নিজ ইচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়েছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিরা সবাই দেড়মাস থেকে দুই বছরের অধিক সময় বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। অনেকের পরিবার জানে তার সন্তান বিদেশে কোনও চাকরিতে রয়েছেন। মাঝে মাঝে তারা টাকাও পাঠাচ্ছেন। কিছুদিন আগে ২০২১ সালের মার্চের শেষের দিকে সিলেটের সিদ্দিক এবং রাজ্জাক নামে দু’জন নিরুদ্দেশ হন। অনেকেই জানেন তারা আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়েছেন। তবে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে এবং আমরা যাদের আটক করেছি তাদের তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পেরেছি তারাও এই পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তারা এখানেই অবস্থান করছেন এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
এসএম শামসুজ্জোহা
২৩ অক্টোবর, ২০২২, 8:38 PM
জঙ্গিবাদ সারাবিশ্বের জন্য এখন একটি বড় আতঙ্ক। পাহাড়ে একাধিক গোপন আস্তানায় সম্প্রতি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নতুন করে কথিত হিজরতের নামে ঘরছাড়া তরুণরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন দেশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
এসব আস্তানায় হিজরত করা তরুণদের ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফগানফেরত বাংলাদেশি মুজাহিদরাই গোপনে জঙ্গি কর্মকান্ড অব্যাহত রাখার তথ্য পেয়েছে বলে দাবী করছে দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। আফগানফেরত এসব যোদ্ধাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
জামায়াত-শিবিরের এক শ্রেণির উগ্রবাদী গোষ্ঠী নেপথ্যে থেকে নানাভাবে তাদের সহায়তা দিচ্ছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দারা। তাদের তথ্য মতে, জামায়াত-শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতি যখন বন্ধপ্রায় তখন আফগানফেরত এসব যোদ্ধা ইসলামের নামে ধর্মভীরু মানুষের ভেতর ছড়িয়ে দিচ্ছে জঙ্গি মনোভাব। তবে জঙ্গিদের আগের মতো জানান দেওয়ার সুযোগ নেই বলে দেশের মাঠ পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জোর দিয়ে বলছেন।
সম্প্রতি বান্দরবান ও রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তাদের মধ্যে ৭ জন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্য এবং ৩ জন পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সদস্য। গ্রেফতারকালে তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। আফগানফেরত বাংলাদেশি মুজাহিদরাই হিজরত করা তরুণদের অস্ত্র ও যুদ্ধক্ষেত্র প্রশিক্ষণে পাহাড়ে ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিতো বলে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে প্রাথমিক জিঙ্গাসাবাদে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গ্রফতারকৃত ৩ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় তারা স্থানীয় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের সামরিক শাখা কেএনএ’র সক্রিয় সদস্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অস্ত্র চালনাসহ সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গোপনে পরিচালনার জন্য বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম এলাকাকে বেছে নেয় জঙ্গিরা। এজন্য তারা স্থানীয় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ)-এর সহায়তা গ্রহণ করার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করতো। তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ করে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, কেএনফের প্রতিষ্ঠাতা নাথাং বমের সঙ্গে ২০২১ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আমিরের সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং পার্বত্য অঞ্চলের কেএনএফের ছত্রচ্ছায়ায় জামাতুল আনসারের সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য তারা চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা এবং কেএনএফের সব সদস্যের খাবার খরচ বহন করা হতো। এখনো ৫০ জনের বেশি জঙ্গি পাহাড়ে আত্মগোপনে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবাইকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এ ব্যাপারে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, দেশে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শীর্ষ নেতাদের ধরতে পাহাড়ে অভিযান শুরু হয়। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নতুন করে কথিত হিজরতের নামে ঘরছাড়া তরুণরা জামাতুল আনসারের হয়ে পাহাড়ি এলাকার আস্তানায় আশ্রয় নেয়। এসব আস্তানায় হিজরত করা তরুণদের ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফগানফেরত বাংলাদেশি মুজাহিদরাই গোপনে জঙ্গি কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় হিজরতের নামে সম্প্রতি বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ১৯ জেলার ৫৫ তরুণের তালিকা প্রকাশ করে র্যাব। তাদের মধ্যে ৩৮ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি জানা যায়, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ে বাড়িছাড়া কিছু তরুণ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। নতুন এ জঙ্গি সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে আফগান ফেরত মুজাহিদরা আবার পাহাড়ী বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠন কেএনএফ। মঈন বলেন, ‘জঙ্গি সংগঠনগুলোর আগের সেই শক্তিমত্তা নেই। মাঝে-মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করে থাকে। আফগানফেরত কিছু কথিত মুজাহিদ এসব জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেপথ্যে কাজ করছে।’
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন কারাভোগের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে শতাধিক আফগানফেরত যোদ্ধা জামিনে মুক্তি পেয়ে পলাতক জীবন-যাপন করছেন। এদের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা এলাকার বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসায় ছদ্মনামে শিক্ষাদানের আড়ালে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন বলে জানিয়েছে গোয়েন্দাদের একটি সূত্র। আবার তাদের কেউ কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে বলেও গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি কিংবা ব্যবসাও করছেন তারা।
এদের মধ্যে বর্তমানে ২৮ জন এখনো পলাতক জীবন-যাপন করছে। তারা হল- কক্সবাজারের আবুল কাশেম, মানিকগঞ্জের আবুল খায়ের মসরু, নরসিংদীর মোস্তফা কামাল, চকরিয়ার রেজাউল করিম, হাফেজ সিরাজুল করিম, পটুয়াখালীর ইব্রাহিম খলিলউল্লাহ, গোপালগঞ্জের বোরহান উদ্দিন মামুন, আবুল হোসেন ওরফে আবুল হাসেম, মিরসরাইয়ের দিদারুল আলম, ফেনীর জসিম উদ্দিন, আবদুল আজিজ, গিয়াস, দিনাজপুরের রাশিদুল ইসলাম, ময়মনসিংহের আবুল কাশেম, চট্টগ্রামের আবদুল আজিজ ওরফে হালিম ওরফে সেলিম নুরুল আলম, বাহাউদ্দিন ওরফে বাগার উদ্দিন, শামসুল ইসলাম, চাঁদপুরের মাওলানা আবদুস সোবহান, আবু জিহাদ, হবিগঞ্জের নুরুল হক, মাওলানা আবু তাহের, কিশোরগঞ্জের মুহিবুর রহমান, শরিয়ত উল্লাহ, দিনাজপুরের রাশেদুল ইসলাম, যশোরের শেখ আনিছুর রহমান, রাজবাড়ীর হাফেজ আলী, ইয়াছ আহম্মেদ, খুলনার হাফেজ আবু তাহের।
গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) হারুন অর রশিদ বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের প্রশিক্ষণ শিবিরে মোট প্রশিক্ষণার্থী অর্ধশতাধিক। আফগান ফেরত মুজাহিদ আনিসুর রহমান মাহমুদের নেতৃত্বে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামের উগ্রবাদী সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া এই সংগঠনে ছয় জন শূরা সদস্য রয়েছে, যারা দাওয়াতি, সামরিক, অর্থ, মিডিয়া ও উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছে। শূরা সদস্য আবদুল্লাহ মাইমুন দাওয়াতি শাখার প্রধান, মাসকুর রহমান সামরিক শাখার প্রধান, মারুফ আহমেদ সামরিক শাখার দ্বিতীয় ব্যক্তি, মোশারফ হোসেন অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান, শামীম মাহফুজ প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং ভোলার শায়েখ আলেম বিভাগের প্রধান হিসেবে সংগঠনটিতে দায়িত্ব পালন করছে।
তিনি বলেন, এদের ধরতে মাঠে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। পাশাপাশি দেশব্যাপী ব্যাপক গোয়েন্দা নজরদারিও অব্যাহত আছে। ভয়ংকর এসব জঙ্গিদের গ্রেফতার করতে সবগুলো সংস্থা কাজ করছে। ‘এ কথাও সত্য যে, তারা যত ভয়ংকরই হোক না কেন, আর আগের মতো সুযোগ পাবে না। কেননা তাদের নেটওয়ার্ক গোয়েন্দাদের নজরদারিতে আছে।’
র্যাবের জঙ্গিবিরোধী ইন্টেলিজেন্সের একটি সূত্র জানায়, গণতন্ত্র ও মানুষের শত্রু হিসেবে জঙ্গিবাদকে দমন করার জন্য প্রত্যেকটি দেশ যেমন সচেষ্ট হয়েছে, তেমনই জাতিসংঘ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলেছে, আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের শিকড় অনেক ভেতরে চলে গেছে। দেশি-বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থায়ন ও সরবরাহ এদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সংগঠিত হতে সহায়তা করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার যুক্ত রিপোর্টে ১০টি এনজিও এবং ইসলামী সাহায্য সংস্থাকে জঙ্গি অর্থায়ন ও সহায়তায় লিপ্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। এসব টাকা জঙ্গি তৎপরতার কাজে ব্যয় করা হয় বলে গোয়েন্দারা জানিয়েছে।
র্যাব গোয়েন্দা বিভাগের সূত্র মতে, স্লিপার সেল জঙ্গি ভাষায় তাদেরকে ‘মুজাহিদ’ বলা হয়। এরা সবসময় ছদ্মবেশ ধারণ করে চলাফেরা করে থাকে। এরা প্রথমে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের বাছাই করে হত্যার পরিকল্পনা করে। স্লিপার সেলের একজন সদস্যের সঙ্গে অন্য সদস্যের কোন রকম পরিচয় থাকে না। সে মোতাবেক সক্রিয় জঙ্গি নির্দেশনায় সারা দেশে জঙ্গিদের সমন্বয়ে শতাধিক স্লিপার সেল গজিয়ে উঠেছে। এসব সেলের সদস্যদের শিক্ষা-দীক্ষা না থাকলেও তারা যেমন সাহসী তেমনই মানুষ হত্যায় (কতল) বেশ পারদর্শী। প্রতিটি সেলে তিন থেকে চারজন সদস্য থাকে। আফগান ফেরত প্রশিক্ষিত যোদ্ধারাই জেএমবি, হুজি এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গি সদস্যরাই সেলগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে।
বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি দমনে সরকারের বিশেষ টিম মাঠ পর্যায় কাজ করছে এবং খুব শীঘ্রই দেশ থেকে জঙ্গিদের মূলউৎপাটন করা হবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন। তিনি বলেন, তথাকথিত হিজরতের নামে তরুণরা বাড়ি থেকে বের হয়েছেন বা নিজ ইচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়েছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিরা সবাই দেড়মাস থেকে দুই বছরের অধিক সময় বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। অনেকের পরিবার জানে তার সন্তান বিদেশে কোনও চাকরিতে রয়েছেন। মাঝে মাঝে তারা টাকাও পাঠাচ্ছেন। কিছুদিন আগে ২০২১ সালের মার্চের শেষের দিকে সিলেটের সিদ্দিক এবং রাজ্জাক নামে দু’জন নিরুদ্দেশ হন। অনেকেই জানেন তারা আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়েছেন। তবে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে এবং আমরা যাদের আটক করেছি তাদের তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পেরেছি তারাও এই পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তারা এখানেই অবস্থান করছেন এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।