দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের তিন জেলায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট
নাগরিক প্রতিবেদক, খুলনা
১৩ মে, ২০২৪, 1:48 PM
দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের তিন জেলায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট
দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের তিন জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের অন্তত ১৪ উপজেলায় বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এসব উপজেলায় জলাশয় কিংবা গভীর নলকূপের মতো উৎস থাকলেও মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক, লবণাক্ততা ও আয়রনের কারণে তা পানের উপযোগী নয়। এসব এলাকার বাসিন্দাদের, বিশেষ করে নারীদের বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এক কলস পানি আনতে কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে তাদের। এ পরিস্থিতির জন্য কেউ দুষছেন চিংড়ি চাষকে; কেউ দুষছেন সরকারের অপরিকল্পিত ও দায়সারা প্রকল্পকে। এর সঙ্গে মিঠাপানির জলাশয় কমে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকেও যুক্ত করেছেন কেউ কেউ।
খুলনায় খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে তিন উপজেলা কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপে। বাগেরহাটের রামপাল, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও মোংলার পরিস্থিতিও একই। অন্যদিকে সাতক্ষীরার সব উপজেলায়ই কম-বেশি খাওয়ার পানির সংকট রয়েছে। এপ্রিলের শুরু থেকে টানা তাপপ্রবাহে এ সংকট আরো তীব্র হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। দাকোপ উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন সুতারখালী এলাকার বাসিন্দা মকবুল গাজী বলেন, ‘আমাদের খাওয়ার পানির কষ্টটা আর গেল না। কালাবগী, সুতারখালী, কামারখোলা ও গুনারী এলাকায় খাওয়ার পানির সংকট সবচেয়ে তীব্র। টিউবওয়েল ও জলাশয়ের পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা।’
দাকোপ উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, ‘এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি পানের প্রায় অযোগ্য। সুপেয় পানি সরবরাহে টিউবওয়েল, প্লান্ট, পুকুর খনন ও সংস্কার করা হলেও জনসংখ্যার তুলনায় তা অপ্রতুল।’ উপকূলবর্তী কয়রা উপজেলার স্থানীয় সংবাদকর্মী শেখ সিরাজউদ্দৌলা লিংকন বলেন, ‘শীতকাল থেকে বর্ষার আগ পর্যন্ত লম্বা সময় দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। বর্ষা থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৃষ্টির পানি জমিয়ে কিছুদিন চলেন তারা। তবে বেশির ভাগ পরিবারে পানি জমিয়ে রাখার বড় পাত্র নেই। অনেকে টাকা দিয়ে পানি সংগ্রহে বাধ্য হন। রাজধানীর তুলনায় উপকূলে সুপেয় পানি সংগ্রহের খরচও বেশি।’
খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আকমল হোসেন বলেন, ‘উপকূলের লবণাক্ত এলাকায় পানির সংকট মোকাবেলা আমাদের জন্য সবসময়ই চ্যালেঞ্জ। এ সংকট কাটাতে একাধিক প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্প সম্পন্ন হলে এ অঞ্চলের মানুষের পানির কষ্ট কমে আসবে।’ সরজমিনে কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এসব জনপদের চারদিকে পানি থাকলেও তা লবণাক্ত। বেশির ভাগ নারী নদীর পানিতে গোসল ও গৃহস্থালির কাজ সারছেন। ২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক জরিপে দেশের উপকূলীয় মানুষের নিরাপদ খাওয়ার পানির দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়। জরিপে দেখা যায়, উপকূলীয় এলাকার ৭৩ শতাংশ মানুষকে অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করতে হয়।
কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের কলাপাতা গ্রামের সবিতা রানী বলেন, ‘রাত পোহালেই কলসি নিয়ে বের হতে হয়। দুটো বিল পাড়ি দিয়ে সরকারি পুকুর থেকে মিঠাপানি নিয়ে বাড়ি আসতে দেড়-দুই ঘণ্টা সময় লাগে। গরমের মধ্যে তিন-চার মাইল পথ হাঁটতে হয়। পাশের আমতলা, কেয়াবুনিয়া, সিন্দুরতলা ও কলাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দাদেরও একই অবস্থা।’ কয়রা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘উপজেলার অধিকাংশ মানুষ বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভর করে। চলতি মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে পুকুর ও জলাধার শুকিয়ে গেছে। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে পানি কম উঠছে। ফলে সংকট বেড়েছে।’
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ‘বাধ্য হয়ে উপকূলের মানুষ পুকুরের পানি পান করে। এ কারণে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়া ও চর্মরোগ নিয়ে অনেকে হাসপাতালে আসে।’ রেজাউল করিম আরো বলেন, ‘লবণাক্ত পানি পানের মাধ্যমে অতিরিক্ত সোডিয়াম ক্লোরাইড গ্রহণ করছে উপকূলের মানুষ, যা তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে। লবণাক্ত পানি পানের কারণে গর্ভবতী নারীদের কিডনি ও যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’ খুলনার কয়রা-পাইকগাছার সংসদ সদস্য রশীদুজ্জামান বলেন, ‘বছরের পর বছর লোনাপানি আটকে চিংড়ি চাষের কারণে মিঠাপানির পুকুরগুলোর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল, ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ মোতাসিম বিল্লাহ মনে করেন, উপকূলের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও অপরিকল্পিত আর দায়সারা কাজে দীর্ঘমেয়াদি সুফল মিলছে না। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমারি ইউনিয়নের খুটিকাটা গ্রামের নীলিমা সরকার, সাবিত্রি সরকার ও অনিমা মণ্ডল জানান, প্রতিদিন সকালে পার্শ্ববর্তী গ্রাম বড়দল ও কাঠাবাড়ি থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয় তাদের। পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে সংসারের কাজে যেমন ব্যাঘাত ঘটে, তেমনি শারীরিক কষ্ট ও দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
আইলাদুর্গত গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের গৃহবধূ আজমুন নাহার, চাঁদনিমুখা গ্রামের রেখা খাতুন ও ৯ নং সোরা গ্রামের পারুল খাতুন জানান, গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা থেকে পানি আনতে গেলে তাদের এক বেলা সময় নষ্ট হয়। গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মাকসুদুল আলম জানান, তার ইউনিয়নে ১৫টি গ্রামের মধ্যে ১১টি গ্রামে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট। বিশেষ করে চাঁদনিমুখা, ডুমুরিয়া, খলশিবুনিয়া, হেতালবুনিয়া, চকবারা, সোরা ও পার্শ্বেমারী গ্রামের নারীরা অনেক দূর থেকে হেঁটে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন। তার ইউনিয়নের ৪২ হাজার মানুষের মধ্যে অন্তত ৩৬ হাজার সুপেয় পানি সংকটে রয়েছে। শ্যামনগরের মতো অবস্থা জেলার আশাশুনি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, তালা, কলারোয়া ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলায়।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আইলা ও সিডরের আঘাতের পর থেকে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলে খাওয়ার পানি বা সুপেয় পানির সংকট আরো তীব্র হয়েছে। লবণাক্ত পানি ঢুকে সে সময় উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ মিঠাপানির আধার ও জলাশয়গুলোর মারাত্মক ক্ষতি হয়, যা আজও স্বাভাবিক হয়নি। বিশেষ করে শ্যামনগর, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলার মানুষজন খাওয়ার পানির তীব্র সংকটে রয়েছে।’ সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডা. মানস কুমার জানান, দীর্ঘদিন ধরে লবণাক্ত পানি পান করলে কিডনি ও লিভার নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি নানা ধরনের চর্মরোগ হতে পারে। সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুল ইসলাম জানান, জেলার ২৫-৩০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির কষ্টে আছে। তিনি বলেন, ‘সুপেয় পানি সংকট নিরসনে ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ চলছে। ২০২৬ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এ প্রকল্পের ফলে জেলার অন্তত দুই লাখ মানুষ সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে পারবে।’
নাগরিক প্রতিবেদক, খুলনা
১৩ মে, ২০২৪, 1:48 PM
দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের তিন জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের অন্তত ১৪ উপজেলায় বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এসব উপজেলায় জলাশয় কিংবা গভীর নলকূপের মতো উৎস থাকলেও মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক, লবণাক্ততা ও আয়রনের কারণে তা পানের উপযোগী নয়। এসব এলাকার বাসিন্দাদের, বিশেষ করে নারীদের বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এক কলস পানি আনতে কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে তাদের। এ পরিস্থিতির জন্য কেউ দুষছেন চিংড়ি চাষকে; কেউ দুষছেন সরকারের অপরিকল্পিত ও দায়সারা প্রকল্পকে। এর সঙ্গে মিঠাপানির জলাশয় কমে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকেও যুক্ত করেছেন কেউ কেউ।
খুলনায় খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে তিন উপজেলা কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপে। বাগেরহাটের রামপাল, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও মোংলার পরিস্থিতিও একই। অন্যদিকে সাতক্ষীরার সব উপজেলায়ই কম-বেশি খাওয়ার পানির সংকট রয়েছে। এপ্রিলের শুরু থেকে টানা তাপপ্রবাহে এ সংকট আরো তীব্র হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। দাকোপ উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন সুতারখালী এলাকার বাসিন্দা মকবুল গাজী বলেন, ‘আমাদের খাওয়ার পানির কষ্টটা আর গেল না। কালাবগী, সুতারখালী, কামারখোলা ও গুনারী এলাকায় খাওয়ার পানির সংকট সবচেয়ে তীব্র। টিউবওয়েল ও জলাশয়ের পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা।’
দাকোপ উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, ‘এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি পানের প্রায় অযোগ্য। সুপেয় পানি সরবরাহে টিউবওয়েল, প্লান্ট, পুকুর খনন ও সংস্কার করা হলেও জনসংখ্যার তুলনায় তা অপ্রতুল।’ উপকূলবর্তী কয়রা উপজেলার স্থানীয় সংবাদকর্মী শেখ সিরাজউদ্দৌলা লিংকন বলেন, ‘শীতকাল থেকে বর্ষার আগ পর্যন্ত লম্বা সময় দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। বর্ষা থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৃষ্টির পানি জমিয়ে কিছুদিন চলেন তারা। তবে বেশির ভাগ পরিবারে পানি জমিয়ে রাখার বড় পাত্র নেই। অনেকে টাকা দিয়ে পানি সংগ্রহে বাধ্য হন। রাজধানীর তুলনায় উপকূলে সুপেয় পানি সংগ্রহের খরচও বেশি।’
খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আকমল হোসেন বলেন, ‘উপকূলের লবণাক্ত এলাকায় পানির সংকট মোকাবেলা আমাদের জন্য সবসময়ই চ্যালেঞ্জ। এ সংকট কাটাতে একাধিক প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্প সম্পন্ন হলে এ অঞ্চলের মানুষের পানির কষ্ট কমে আসবে।’ সরজমিনে কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এসব জনপদের চারদিকে পানি থাকলেও তা লবণাক্ত। বেশির ভাগ নারী নদীর পানিতে গোসল ও গৃহস্থালির কাজ সারছেন। ২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক জরিপে দেশের উপকূলীয় মানুষের নিরাপদ খাওয়ার পানির দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়। জরিপে দেখা যায়, উপকূলীয় এলাকার ৭৩ শতাংশ মানুষকে অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করতে হয়।
কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের কলাপাতা গ্রামের সবিতা রানী বলেন, ‘রাত পোহালেই কলসি নিয়ে বের হতে হয়। দুটো বিল পাড়ি দিয়ে সরকারি পুকুর থেকে মিঠাপানি নিয়ে বাড়ি আসতে দেড়-দুই ঘণ্টা সময় লাগে। গরমের মধ্যে তিন-চার মাইল পথ হাঁটতে হয়। পাশের আমতলা, কেয়াবুনিয়া, সিন্দুরতলা ও কলাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দাদেরও একই অবস্থা।’ কয়রা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘উপজেলার অধিকাংশ মানুষ বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভর করে। চলতি মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে পুকুর ও জলাধার শুকিয়ে গেছে। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে পানি কম উঠছে। ফলে সংকট বেড়েছে।’
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ‘বাধ্য হয়ে উপকূলের মানুষ পুকুরের পানি পান করে। এ কারণে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়া ও চর্মরোগ নিয়ে অনেকে হাসপাতালে আসে।’ রেজাউল করিম আরো বলেন, ‘লবণাক্ত পানি পানের মাধ্যমে অতিরিক্ত সোডিয়াম ক্লোরাইড গ্রহণ করছে উপকূলের মানুষ, যা তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে। লবণাক্ত পানি পানের কারণে গর্ভবতী নারীদের কিডনি ও যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’ খুলনার কয়রা-পাইকগাছার সংসদ সদস্য রশীদুজ্জামান বলেন, ‘বছরের পর বছর লোনাপানি আটকে চিংড়ি চাষের কারণে মিঠাপানির পুকুরগুলোর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল, ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ মোতাসিম বিল্লাহ মনে করেন, উপকূলের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও অপরিকল্পিত আর দায়সারা কাজে দীর্ঘমেয়াদি সুফল মিলছে না। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমারি ইউনিয়নের খুটিকাটা গ্রামের নীলিমা সরকার, সাবিত্রি সরকার ও অনিমা মণ্ডল জানান, প্রতিদিন সকালে পার্শ্ববর্তী গ্রাম বড়দল ও কাঠাবাড়ি থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয় তাদের। পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে সংসারের কাজে যেমন ব্যাঘাত ঘটে, তেমনি শারীরিক কষ্ট ও দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
আইলাদুর্গত গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের গৃহবধূ আজমুন নাহার, চাঁদনিমুখা গ্রামের রেখা খাতুন ও ৯ নং সোরা গ্রামের পারুল খাতুন জানান, গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা থেকে পানি আনতে গেলে তাদের এক বেলা সময় নষ্ট হয়। গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মাকসুদুল আলম জানান, তার ইউনিয়নে ১৫টি গ্রামের মধ্যে ১১টি গ্রামে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট। বিশেষ করে চাঁদনিমুখা, ডুমুরিয়া, খলশিবুনিয়া, হেতালবুনিয়া, চকবারা, সোরা ও পার্শ্বেমারী গ্রামের নারীরা অনেক দূর থেকে হেঁটে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন। তার ইউনিয়নের ৪২ হাজার মানুষের মধ্যে অন্তত ৩৬ হাজার সুপেয় পানি সংকটে রয়েছে। শ্যামনগরের মতো অবস্থা জেলার আশাশুনি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, তালা, কলারোয়া ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলায়।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আইলা ও সিডরের আঘাতের পর থেকে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলে খাওয়ার পানি বা সুপেয় পানির সংকট আরো তীব্র হয়েছে। লবণাক্ত পানি ঢুকে সে সময় উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ মিঠাপানির আধার ও জলাশয়গুলোর মারাত্মক ক্ষতি হয়, যা আজও স্বাভাবিক হয়নি। বিশেষ করে শ্যামনগর, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলার মানুষজন খাওয়ার পানির তীব্র সংকটে রয়েছে।’ সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডা. মানস কুমার জানান, দীর্ঘদিন ধরে লবণাক্ত পানি পান করলে কিডনি ও লিভার নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি নানা ধরনের চর্মরোগ হতে পারে। সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুল ইসলাম জানান, জেলার ২৫-৩০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির কষ্টে আছে। তিনি বলেন, ‘সুপেয় পানি সংকট নিরসনে ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ চলছে। ২০২৬ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এ প্রকল্পের ফলে জেলার অন্তত দুই লাখ মানুষ সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে পারবে।’