ভারতে স্কুলবই থেকে মুছে যাচ্ছে মুঘল ইতিহাস 

#
news image

ভারতের দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস সম্বলিত অধ্যায়টি সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার একাদশ শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানের বই থেকে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গে দুটি অধ্যায়ও বাদ দেয়া হয়েছে। আরো কয়েকটি বদল ঘটানো হয়েছে পাঠ্য বইতে, যা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। কেন্দ্রীয় সংস্থা জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও শিক্ষণ কাউন্সিল (এনসিইআরটি) সারা দেশের স্কুলগুলোর জন্য পাঠ্যবই প্রকাশ করে। এ বছরের জন্য তারা দ্বাদশ শ্রেণির জন্য যে বইটি প্রকাশ করেছে, সেই বই ‘থিমস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ তিনটি ভাগে ছাপা হয়েছে।

দ্বিতীয় ভাগের নবম অধ্যায়তেই ছিল রাজা এবং ইতিহাস, মুঘল দরবার অংশটি।এনসিইআরটির ওয়েবসাইটে নতুন ইতিহাস বইটি ডাউনলোড করার জন্য যে লিংক আছে, সেখানে মুঘল শাসকদের নিয়ে ২৮ পাতার যে অধ্যায়টি ছিল, তা এখন আর নেই। মুসলমান শাসকদের ইতিহাস পাঠ্যক্রম থেকে সরিয়ে দেয়ার এই প্রচেষ্টাকে ভারতের ইতিহাস থেকে মুঘলদের মুছে ফেলার চেষ্টা বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে এনসিইআরটি যুক্তি দিয়েছে যে ছাত্রছাত্রীদের ওপর থেকে ‘পাঠ্যক্রমের বোঝা কম’ করতেই এই অধ্যায়টি সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে বইটিতে এখনো কিছু অধ্যায়ের মধ্যে মুঘলদের উল্লেখ রয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়তে যেমন দশম থেকে সপ্তদশ শতকের ভারতের কথা বলা হয়েছে, আর ষষ্ঠ অধ্যায়তে ভক্তি ও সুফি পরম্পরা আলোচনা করার সময়েও মুঘল আমলের প্রসঙ্গ আছে। অষ্টম অধ্যায়তে কৃষক, জমিদার ও মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে লেখা হয়েছে।

পাঠ্যবই বদল হলো কেন?
পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনের পক্ষে বলতে গিয়ে এনসিইআরটির প্রধান দিনেশ সাকলানি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘মুঘলদের ইতিহাস বাদ দিয়ে দেয়া হয়নি, ছাত্রছাত্রীদের ওপর থেকে পাঠ্যক্রমের বোঝা কিছুটা কমানো হয়েছে।’ তার কথায়, ‘আমরা গতবছরই বলেছিলাম যে করোনা মহামারীর কারণে ছাত্রছাত্রীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে, তাদের ওপরে চাপ বেড়েছে। পাঠ্যক্রমের বোঝা তাই কিছুটা কম করা হলো। আর এটা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী করা হয়েছে।’ পাঠ্যবইতে পরিবর্তন শুধু যে ইতিহাসের বইয়ে করা হয়েছে, তা নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই থেকেও বেশ কিছু অংশ বাদ দেয়া হয়েছে, যেখানে হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতিবাচক মনোভাব প্রসঙ্গে লেখা ছিল। গান্ধীর হত্যার পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সক্সঘকে (আরএসএস) নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল, সেই অংশটাও সরিয়ে দেয়া হয়েছে। রাজনীতির অঙ্গনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও আরএসএস জওহরলাল নেহরু-ইন্দিরা গান্ধী পরিবারের বিপরীতে বল্লভভাই প্যাটেলকে তুলে ধরতে চায়। গুজরাতে বিশ্বের সব থেকে উঁচু যে মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটাও বল্লভভাই প্যাটেলের।

পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক : বিজেপি বিরোধী রাজ্যগুলো এনসিইআরটির পাঠ্য বইতে এসব পরিবর্তনের বিরোধিতা করছে, আবার উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো বলছে তারা নতুন বই পড়াবে। এনসিইআরটির সাবেক চেয়ারম্যান জে এস রাজপুত বিজেপির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।

তিনি বলছিলেন, ‘এনসিইআরটি একটা বড় প্রতিষ্ঠান। সেখানে বিশেষজ্ঞরা আছেন। তারা যখন কোনো পরিবর্তন করেন, সেগুলো অ্যাকাডেমিকই হয়। ইতিহাসের বইতে যদি কোথাও কেউ নিজস্ব ভাবনা আর তত্ত্ব যোগ করে থাকেন, সেগুলো সরিয়ে দেয়াই উচিত। কিন্তু মুঘল আমলের ইতিহাস পুরোপুরি সরিয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু আমারও এটা মনে হতো যে মুঘল আমলের ইতিহাস খুব বেশি করে পড়ানো হচ্ছে। যেন শুধু মুঘল আমলেই ভারতবর্ষের অস্তিত্ব ছিল! আবার ইতিহাসের কোনো একটা সময়ের কিছু অংশ বাদ দিয়ে পড়ানোটাও অনুচিত।’

ইতিহাসের প্রতি সুবিচার হলো না : একটা সময়ে এনসিইআরটির দ্বাদশ শ্রেণির বই মুঘল আমলের ইতিহাসের জন্য স্নাতক স্তরের ছাত্রছাত্রীদেরও পড়তে পরামর্শ দিতেন অধ্যাপকরা। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার উত্তরপাড়া প্যারিমোহন কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান, সহযোগী অধ্যাপক শর্মিষ্ঠা নাথ বলছিলেন, ‘আমি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হই, এক বিখ্যাত অধ্যাপক বলেছিলেন মুঘল আমলের ইতিহাসের ভিত তৈরি করতে হলে এনসিইআরটির পাঠ্যবই পড়বে তোমরা। এতটাই সমৃদ্ধ ছিল বইটা।’ বিএ ক্লাসের ছাত্রী হয়েও দ্বাদশ শ্রেণির এনসিইআরটির পাঠ্য বই পড়েই শর্মিষ্ঠা নাথের মুঘল আমলের ইতিহাস নিয়ে ভিতটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘এখন মুঘল আমলের ইতিহাস বাদ দিয়ে দেয়া ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করা হলো না। মুঘল আমল না পড়লে ছাত্রছাত্রীরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতা কী করে বুঝবে?’ তিনি আরো বলেন, ‘বরঞ্চ যেটা করা যেতে পারত, মুঘল আমল সম্পর্কে নতুন তথ্য, নতুন গবেষণার ভিত্তিতে যা পাওয়া গেছে, যেমন সম্রাট আকবরকে শুধুই ‘দ্যা গ্রেট’ বলে না দেখিয়ে তার নেতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরা বা অন্য মুঘল সম্রাটদের সমালোচনামূলক দিকগুলো তুলে ধরা- এটা করাই যেত।’

কাল্পনিক ইতিহাস তৈরির চেষ্টা : ইতিহাসবিদরা বলছেন, ইতিহাস তো ইতিহাসই, কেউ চাইলেই তো আর সেটা মুছে ফেলা যায় না। তবে নতুন করে কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য পেলে নিশ্চই ইতিহাসকে নতুনভাবে দেখার সুযোগ আছে, সেটা করাও হয়। ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের সচিব অধ্যাপক সৈয়দ আলি নাদিম রিজভি বলেন, ‘ইতিহাসের পাঠ্যবইতে পরিবর্তন কোনো নতুন ঘটনা নয়, এটা হতেই থাকে। কিন্তু সেই সব পরিবর্তন হওয়া উচিত নতুন কোনো তথ্য, নতুন গবেষণার ভিত্তিতে। এর আগে অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারের সময়েও ইতিহাস বইতে বদল আনার চেষ্টা হয়েছিল। ওই সব পরিবর্তনগুলো তথ্য আর গবেষণার ভিত্তিতে করা হয়েছিল। কিন্তু এখন তো একটা কাল্পনিক ইতিহাস তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে।’ এনসিইআরটির ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞানের বইতে পরিবর্তনগুলো নিয়ে অভিযোগ উঠছে যে একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার ওপরে ভিত্তি করেই এই বদলগুলো করা হয়েছে। সেই ভাবধারা হল হিন্দুত্ববাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং মুসলমান বিরোধিতা। ওই একই চিন্তাধারার ওপরে ভিত্তি করেই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে রাস্তা, স্টেশন, জেলা বা শহরের নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা সব থেকে বেশি দেখা গেছে উত্তরপ্রদেশে। ভারতীয় রেলপথের অতি গুরুত্বপূর্ণ মোগলসরাই স্টেশনের নাম পাল্টিয়ে রাখা হয়েছে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন, এলাহাবাদ শহরের নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ। বেশ কয়েক বছর আগেই মহারাষ্ট্রের স্কুলপাঠ্য বই থেকে মুঘল আমলকে সরিয়ে ছত্রপতি শিবাজির ইতিহাস নিয়ে আসা হয়েছে। বিজেপি শাসিত কর্ণাটক রাজ্যেও টিপু সুলতানের ইতিহাস মুছে ফেলার একাধিকবার চেষ্টা হয়েছে। বিতর্ক যে শুধু ইতিহাসের পাঠ্যবই নিয়ে হচ্ছে, তা নয়। সমাজবিজ্ঞানের বই থেকে গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের আরএসএস ঘনিষ্ঠতার পরিচয় সরিয়ে দেয়া নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে।

মুসলমান আমল নিয়ে একাধিক ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস লিখেছেন কলকাতার প্রাবন্ধিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত। তিনি বলছিলেন, ‘মুঘল আমল বা মুসলমান শাসকদের আমল তো ভারতের ইতিহাসেরই অঙ্গ। তাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে ভারতের শিল্প, সংস্কৃতিতে। আর বর্তমানে আমরা যে জেলাওয়াড়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থায় চলি, সেটাও তো মুঘলদেরই অবদান। সেসব অস্বীকার করব কী করে।’ তিনি আরো বলছিলেন, ‘আবার গান্ধী হত্যাকারীর আরএসএস সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করব পাঠ্যবইতে, কিন্তু সবরমতী আশ্রমে গিয়ে চরকা কাঁটার ছবি তুলবেন প্রধানমন্ত্রী, এ তো দ্বিচারিতা।’ এনসিইআরটির ইতিহাস বইতে পরিবর্তনের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন ভারতের প্রায় ২৫০ জন নামকরা ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ। শনিবার এক বিবৃতি জারি করে ইরফান হাবিব, আদিত্য মুখার্জি, অপূর্বানন্দ, জয়তি ঘোষের মতো শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসকারেরা বলছেন, পাঠ্যবইতে এইসব পরিবর্তন বিভেদকামী রাজনীতিকে উৎসাহ দেবে।
সূত্র : বিবিসি

নাগরিক অনলাইন ডেস্ক

০৯ এপ্রিল, ২০২৩,  11:41 AM

news image

ভারতের দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস সম্বলিত অধ্যায়টি সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার একাদশ শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানের বই থেকে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গে দুটি অধ্যায়ও বাদ দেয়া হয়েছে। আরো কয়েকটি বদল ঘটানো হয়েছে পাঠ্য বইতে, যা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। কেন্দ্রীয় সংস্থা জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও শিক্ষণ কাউন্সিল (এনসিইআরটি) সারা দেশের স্কুলগুলোর জন্য পাঠ্যবই প্রকাশ করে। এ বছরের জন্য তারা দ্বাদশ শ্রেণির জন্য যে বইটি প্রকাশ করেছে, সেই বই ‘থিমস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ তিনটি ভাগে ছাপা হয়েছে।

দ্বিতীয় ভাগের নবম অধ্যায়তেই ছিল রাজা এবং ইতিহাস, মুঘল দরবার অংশটি।এনসিইআরটির ওয়েবসাইটে নতুন ইতিহাস বইটি ডাউনলোড করার জন্য যে লিংক আছে, সেখানে মুঘল শাসকদের নিয়ে ২৮ পাতার যে অধ্যায়টি ছিল, তা এখন আর নেই। মুসলমান শাসকদের ইতিহাস পাঠ্যক্রম থেকে সরিয়ে দেয়ার এই প্রচেষ্টাকে ভারতের ইতিহাস থেকে মুঘলদের মুছে ফেলার চেষ্টা বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে এনসিইআরটি যুক্তি দিয়েছে যে ছাত্রছাত্রীদের ওপর থেকে ‘পাঠ্যক্রমের বোঝা কম’ করতেই এই অধ্যায়টি সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে বইটিতে এখনো কিছু অধ্যায়ের মধ্যে মুঘলদের উল্লেখ রয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়তে যেমন দশম থেকে সপ্তদশ শতকের ভারতের কথা বলা হয়েছে, আর ষষ্ঠ অধ্যায়তে ভক্তি ও সুফি পরম্পরা আলোচনা করার সময়েও মুঘল আমলের প্রসঙ্গ আছে। অষ্টম অধ্যায়তে কৃষক, জমিদার ও মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে লেখা হয়েছে।

পাঠ্যবই বদল হলো কেন?
পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনের পক্ষে বলতে গিয়ে এনসিইআরটির প্রধান দিনেশ সাকলানি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘মুঘলদের ইতিহাস বাদ দিয়ে দেয়া হয়নি, ছাত্রছাত্রীদের ওপর থেকে পাঠ্যক্রমের বোঝা কিছুটা কমানো হয়েছে।’ তার কথায়, ‘আমরা গতবছরই বলেছিলাম যে করোনা মহামারীর কারণে ছাত্রছাত্রীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে, তাদের ওপরে চাপ বেড়েছে। পাঠ্যক্রমের বোঝা তাই কিছুটা কম করা হলো। আর এটা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী করা হয়েছে।’ পাঠ্যবইতে পরিবর্তন শুধু যে ইতিহাসের বইয়ে করা হয়েছে, তা নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই থেকেও বেশ কিছু অংশ বাদ দেয়া হয়েছে, যেখানে হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতিবাচক মনোভাব প্রসঙ্গে লেখা ছিল। গান্ধীর হত্যার পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সক্সঘকে (আরএসএস) নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল, সেই অংশটাও সরিয়ে দেয়া হয়েছে। রাজনীতির অঙ্গনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও আরএসএস জওহরলাল নেহরু-ইন্দিরা গান্ধী পরিবারের বিপরীতে বল্লভভাই প্যাটেলকে তুলে ধরতে চায়। গুজরাতে বিশ্বের সব থেকে উঁচু যে মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটাও বল্লভভাই প্যাটেলের।

পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক : বিজেপি বিরোধী রাজ্যগুলো এনসিইআরটির পাঠ্য বইতে এসব পরিবর্তনের বিরোধিতা করছে, আবার উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো বলছে তারা নতুন বই পড়াবে। এনসিইআরটির সাবেক চেয়ারম্যান জে এস রাজপুত বিজেপির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।

তিনি বলছিলেন, ‘এনসিইআরটি একটা বড় প্রতিষ্ঠান। সেখানে বিশেষজ্ঞরা আছেন। তারা যখন কোনো পরিবর্তন করেন, সেগুলো অ্যাকাডেমিকই হয়। ইতিহাসের বইতে যদি কোথাও কেউ নিজস্ব ভাবনা আর তত্ত্ব যোগ করে থাকেন, সেগুলো সরিয়ে দেয়াই উচিত। কিন্তু মুঘল আমলের ইতিহাস পুরোপুরি সরিয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু আমারও এটা মনে হতো যে মুঘল আমলের ইতিহাস খুব বেশি করে পড়ানো হচ্ছে। যেন শুধু মুঘল আমলেই ভারতবর্ষের অস্তিত্ব ছিল! আবার ইতিহাসের কোনো একটা সময়ের কিছু অংশ বাদ দিয়ে পড়ানোটাও অনুচিত।’

ইতিহাসের প্রতি সুবিচার হলো না : একটা সময়ে এনসিইআরটির দ্বাদশ শ্রেণির বই মুঘল আমলের ইতিহাসের জন্য স্নাতক স্তরের ছাত্রছাত্রীদেরও পড়তে পরামর্শ দিতেন অধ্যাপকরা। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার উত্তরপাড়া প্যারিমোহন কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান, সহযোগী অধ্যাপক শর্মিষ্ঠা নাথ বলছিলেন, ‘আমি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হই, এক বিখ্যাত অধ্যাপক বলেছিলেন মুঘল আমলের ইতিহাসের ভিত তৈরি করতে হলে এনসিইআরটির পাঠ্যবই পড়বে তোমরা। এতটাই সমৃদ্ধ ছিল বইটা।’ বিএ ক্লাসের ছাত্রী হয়েও দ্বাদশ শ্রেণির এনসিইআরটির পাঠ্য বই পড়েই শর্মিষ্ঠা নাথের মুঘল আমলের ইতিহাস নিয়ে ভিতটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘এখন মুঘল আমলের ইতিহাস বাদ দিয়ে দেয়া ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করা হলো না। মুঘল আমল না পড়লে ছাত্রছাত্রীরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতা কী করে বুঝবে?’ তিনি আরো বলেন, ‘বরঞ্চ যেটা করা যেতে পারত, মুঘল আমল সম্পর্কে নতুন তথ্য, নতুন গবেষণার ভিত্তিতে যা পাওয়া গেছে, যেমন সম্রাট আকবরকে শুধুই ‘দ্যা গ্রেট’ বলে না দেখিয়ে তার নেতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরা বা অন্য মুঘল সম্রাটদের সমালোচনামূলক দিকগুলো তুলে ধরা- এটা করাই যেত।’

কাল্পনিক ইতিহাস তৈরির চেষ্টা : ইতিহাসবিদরা বলছেন, ইতিহাস তো ইতিহাসই, কেউ চাইলেই তো আর সেটা মুছে ফেলা যায় না। তবে নতুন করে কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য পেলে নিশ্চই ইতিহাসকে নতুনভাবে দেখার সুযোগ আছে, সেটা করাও হয়। ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের সচিব অধ্যাপক সৈয়দ আলি নাদিম রিজভি বলেন, ‘ইতিহাসের পাঠ্যবইতে পরিবর্তন কোনো নতুন ঘটনা নয়, এটা হতেই থাকে। কিন্তু সেই সব পরিবর্তন হওয়া উচিত নতুন কোনো তথ্য, নতুন গবেষণার ভিত্তিতে। এর আগে অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারের সময়েও ইতিহাস বইতে বদল আনার চেষ্টা হয়েছিল। ওই সব পরিবর্তনগুলো তথ্য আর গবেষণার ভিত্তিতে করা হয়েছিল। কিন্তু এখন তো একটা কাল্পনিক ইতিহাস তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে।’ এনসিইআরটির ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞানের বইতে পরিবর্তনগুলো নিয়ে অভিযোগ উঠছে যে একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার ওপরে ভিত্তি করেই এই বদলগুলো করা হয়েছে। সেই ভাবধারা হল হিন্দুত্ববাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং মুসলমান বিরোধিতা। ওই একই চিন্তাধারার ওপরে ভিত্তি করেই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে রাস্তা, স্টেশন, জেলা বা শহরের নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা সব থেকে বেশি দেখা গেছে উত্তরপ্রদেশে। ভারতীয় রেলপথের অতি গুরুত্বপূর্ণ মোগলসরাই স্টেশনের নাম পাল্টিয়ে রাখা হয়েছে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন, এলাহাবাদ শহরের নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ। বেশ কয়েক বছর আগেই মহারাষ্ট্রের স্কুলপাঠ্য বই থেকে মুঘল আমলকে সরিয়ে ছত্রপতি শিবাজির ইতিহাস নিয়ে আসা হয়েছে। বিজেপি শাসিত কর্ণাটক রাজ্যেও টিপু সুলতানের ইতিহাস মুছে ফেলার একাধিকবার চেষ্টা হয়েছে। বিতর্ক যে শুধু ইতিহাসের পাঠ্যবই নিয়ে হচ্ছে, তা নয়। সমাজবিজ্ঞানের বই থেকে গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের আরএসএস ঘনিষ্ঠতার পরিচয় সরিয়ে দেয়া নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে।

মুসলমান আমল নিয়ে একাধিক ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস লিখেছেন কলকাতার প্রাবন্ধিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত। তিনি বলছিলেন, ‘মুঘল আমল বা মুসলমান শাসকদের আমল তো ভারতের ইতিহাসেরই অঙ্গ। তাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে ভারতের শিল্প, সংস্কৃতিতে। আর বর্তমানে আমরা যে জেলাওয়াড়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থায় চলি, সেটাও তো মুঘলদেরই অবদান। সেসব অস্বীকার করব কী করে।’ তিনি আরো বলছিলেন, ‘আবার গান্ধী হত্যাকারীর আরএসএস সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করব পাঠ্যবইতে, কিন্তু সবরমতী আশ্রমে গিয়ে চরকা কাঁটার ছবি তুলবেন প্রধানমন্ত্রী, এ তো দ্বিচারিতা।’ এনসিইআরটির ইতিহাস বইতে পরিবর্তনের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন ভারতের প্রায় ২৫০ জন নামকরা ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ। শনিবার এক বিবৃতি জারি করে ইরফান হাবিব, আদিত্য মুখার্জি, অপূর্বানন্দ, জয়তি ঘোষের মতো শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসকারেরা বলছেন, পাঠ্যবইতে এইসব পরিবর্তন বিভেদকামী রাজনীতিকে উৎসাহ দেবে।
সূত্র : বিবিসি