ফাঁসছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, ধরা হচ্ছে চাকরিপ্রাপ্তদের
নাগরিক প্রতিবেদন
১১ জুলাই, ২০২৪, 2:10 PM
ফাঁসছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, ধরা হচ্ছে চাকরিপ্রাপ্তদের
গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন, জব্দকৃত মোবাইল ফোনের তথ্য ও জবানবন্দির ভিত্তিতে ফেঁসে যাচ্ছেন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রশ্নপত্র ফাঁসে চাকরি পাওয়া কর্মকর্তারা। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের একটি স্তর পর্যন্ত গ্রেপ্তারে সরকারের শীর্ষ মহলের সবুজ সংকেত রয়েছে বলেও জানা গেছে। এরই মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত ছয়জনের জবানবন্দিতে নাম আসা পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারী, চাকরি পাওয়া কর্মকর্তা ও প্রশ্নপত্র বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারে মাঠে কাজ করছে পুলিশ অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অন্যদিকে বিএসএস ক্যাডারের সুনাম রক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করে চাকরি পাওয়া ব্যক্তিদের শাস্তি চান বিভিন্ন ক্যাডার কর্মকর্তারা।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আসামিদের দেওয়া তথ্য, ডিজিটাল প্রমাণ ও আলামত যাচাই-বাছাই করে আমরা অপরাধীদের শনাক্ত করছি। গ্রেপ্তারের পর দায় স্বীকার করে ছয়জন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, বাকিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করা হবে। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় যাদের নাম আসবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিসিএসসহ অন্যান্য পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে চক্রের সদস্যদের লেনদেনের বড় অংশই হয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমে। চাকরি হওয়ার আগে চক্রের সদস্যরা নগদ টাকার পাশাপাশি ব্যাংকের চেক নিত। ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হওয়া চাকরি পাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে ডিজিটাল প্রমাণ রয়েছে। এ ছাড়া যেসব চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে সরাসরি ক্যাশ টাকা লেনদেন হয়েছে তাদের বিষয়েও সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে। আবার পিএসসির শীর্ষ যেসব কর্মকর্তা গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ পিএসসির অন্য কর্মচারীদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিতেন, তাদের তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। তালিকা ধরে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তারের আগেই তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরিপ্রাপ্তদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর সরকারের সবুজ সংকেতের পর অভিযান শুরু হয়। অভিযানের পর গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে তথ্য, মোবাইল ফোন, উদ্ধার হওয়া ব্যাংকের চেকসহ বিভিন্ন আলামতের ভিত্তিতে একের পর এক চক্রের সদস্যের নাম বেরিয়ে আসে। ধারাবাহিক অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান আমাদের সময়কে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় কারাগারে আটক ১১ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে চেয়ে আজ বৃহস্পতিবার আদালতে আবেদন করা হবে। জানা গেছে, পিএসসির সদস্য ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশ্নফাঁস ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অনেক পুরনো। পিএসসির সাবেক সদস্য অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাফরুল থানার মামলাটি দায়ের করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অধ্যাপক মাহফুজুরের বিরুদ্ধে ২৭তম বিসিাএসের মৌখিক পরীক্ষায় ঘুষ গ্রহণসহ পরীক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। সেই মামলায় মাহফুজুর রহমানের ১৩ বছর সাজাও হয়। ২০০৯ সালের ১৭ জুন তিনি আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠান আদালত।
জানা গেছে, পিএসসির গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর বিরুদ্ধেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ অনেক পুরনো। ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল ‘সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদের পরীক্ষা চলাকালে আবদুর রহমান নামের এক পরীক্ষার্থীকে লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ হাতেনাতে আটক করেন পরীক্ষকরা। সেই মামলার অভিযোগপত্র জমা হলেও একদশকে বিচার শেষ হয়নি। সাজাও হয়নি আবেদ আলীর।
পিএসসি সূত্র জানায়, আবেদ আলী ১৯৯৭ সালে গাড়িচালক হিসেবে পিএসসিতে যোগাদান করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার ঢাকার আদালতে ৬ জনের দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসে চাকরি পাওয়া অনেকের নাম বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে কয়েকজন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাও রয়েছেন। এর মধ্যে পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমানের দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষার ১০ জন প্রার্থীর কাছে প্রশ্নফাঁস করেন খলিল। এর মধ্যে তিনজন বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করছেন।
বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করা অন্তত ৬ জন কর্মকর্তারা সঙ্গে কথা হয় আমাদের সময়ের। তারা বলেন, কয়েকজন অপরাধীর দায় মেধাবীরা নেবে কেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসে যারা চাকরি পেয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এখানে রাখঢাক করার কিছু নেই। ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রতি সম্মান ও আস্থা ফেরাতেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আসা উচিত এসব কর্মকর্তাদের।
পিএসসি সূত্র জানিয়েছে, প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের ধরতে নিজেদের গঠিত তদন্ত কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করছে। পিএসসির প্রশ্ন প্রণয়নকারীসহ সংশ্লিষ্ট কাউকে সন্দেহের বাইরে রাখা হচ্ছে না। পিএসসির তদন্ত কমিটির প্রধান পিএসসির যুগ্ম সচিব ড. আব্দুল আলীম বলেন, তদন্তকাজ সম্পন্ন করতে ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। যেসব ইস্যু নিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করছি।
প্রসঙ্গত, গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আলোচিত গাড়িচালক আবেদ আলী ও তার ছেলে সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের মধ্যে পিএসসির দুজন উপপরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালকসহ পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
কখনো পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ছিলেন না আবেদ আলী : পিএসসির চাকরিচ্যুত গাড়িচালক গ্রেপ্তারকৃত সৈয়দ আবেদ আলী কখনো পিএসসির কোনো চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ছিলেন না বলে পিএসসি সূত্র জানিয়েছে। তবে কর্মজীবনে তিনি কমিশনের তিনজন সদস্য ও একজন যুগ্ম সচিবের গাড়িচালক ছিলেন। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসির) সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালে যোগদানের পর থেকে সৈয়দ আবেদ আলী (জীবন) পিএসির সদস্য মজিবুর রহমান বিশ্বাস, মো. মোজাম্মেল হক, মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাত এবং একজন যুগ্মসচিবের গাড়িচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জানা গেছে, অধ্যাপক ড. মো. মুস্তফা চৌধুরী পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৮-২০০২ সাল পর্যন্ত। এ সময় তার গাড়িচালক ছিলেন আলমগীর হোসেন। ২০০২-২০০৭ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান পদে থাকা অধ্যাপক ড. জিনাতুন নেসা তাহমিদা বেগমের গাড়িচালকও ছিলেন আলমগীর হোসেন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. সা’দত হুসাইন। তার সময়েও আলমগীর হোসেনই গাড়িচালক ছিলেন। তারপর নিয়োগ পাওয়া ইকরাম আহমেদের গাড়িচালক ছিলেন আবু বক্কর সিদ্দিক। এর পরের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিকের গাড়িচালক ছিলেন মোট তিনজন। তারা হলেন আবু বক্কর সিদ্দিক, শহিদ ও অনুত্তর চাকমা। পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইনের গাড়িচালক হিসেবে বর্তমানে কর্মরত অনুত্তর চাকমা।
দুদকে পিএসসির চিঠি : সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। গতকাল বুধবার বিকালে পিএসসি থেকে দুদকের সচিব বরাবর এ চিঠি পাঠানো হয়। পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এসএম মতিউর রহমান চিঠি পাঠানো কথা স্বীকার করেন। এ পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেন, পিএসপির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক এসএম আলমগীর কবির, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ, পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্নপত্র প্রকাশ এবং বিতরণ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসেবে অপরাধ সংঘটনে জড়িত থাকার অভিযোগে কর্ম কমিশনের ৫ জনসহ অন্যান্যকে আসামি করে পল্টন থানার মামলা হয়েছে। তারা বর্তমানে জেলে আছেন। তারা ও তাদের পরিবারের সদস্যের নামে অসাধু উপায়ে অর্জিত ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর তফসিলভুক্ত অপরাধ হওয়ায় কমিশন কর্তৃক তদন্তপূর্বক উপযুক্ত আদালতে বিচারার্থ মামলা দায়ের করার লক্ষ্যে সাক্ষ্য প্রমাণাদি সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
নাগরিক প্রতিবেদন
১১ জুলাই, ২০২৪, 2:10 PM
গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন, জব্দকৃত মোবাইল ফোনের তথ্য ও জবানবন্দির ভিত্তিতে ফেঁসে যাচ্ছেন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রশ্নপত্র ফাঁসে চাকরি পাওয়া কর্মকর্তারা। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের একটি স্তর পর্যন্ত গ্রেপ্তারে সরকারের শীর্ষ মহলের সবুজ সংকেত রয়েছে বলেও জানা গেছে। এরই মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত ছয়জনের জবানবন্দিতে নাম আসা পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারী, চাকরি পাওয়া কর্মকর্তা ও প্রশ্নপত্র বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারে মাঠে কাজ করছে পুলিশ অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অন্যদিকে বিএসএস ক্যাডারের সুনাম রক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করে চাকরি পাওয়া ব্যক্তিদের শাস্তি চান বিভিন্ন ক্যাডার কর্মকর্তারা।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আসামিদের দেওয়া তথ্য, ডিজিটাল প্রমাণ ও আলামত যাচাই-বাছাই করে আমরা অপরাধীদের শনাক্ত করছি। গ্রেপ্তারের পর দায় স্বীকার করে ছয়জন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, বাকিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করা হবে। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় যাদের নাম আসবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিসিএসসহ অন্যান্য পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে চক্রের সদস্যদের লেনদেনের বড় অংশই হয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমে। চাকরি হওয়ার আগে চক্রের সদস্যরা নগদ টাকার পাশাপাশি ব্যাংকের চেক নিত। ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হওয়া চাকরি পাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে ডিজিটাল প্রমাণ রয়েছে। এ ছাড়া যেসব চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে সরাসরি ক্যাশ টাকা লেনদেন হয়েছে তাদের বিষয়েও সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে। আবার পিএসসির শীর্ষ যেসব কর্মকর্তা গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ পিএসসির অন্য কর্মচারীদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিতেন, তাদের তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। তালিকা ধরে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তারের আগেই তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরিপ্রাপ্তদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর সরকারের সবুজ সংকেতের পর অভিযান শুরু হয়। অভিযানের পর গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে তথ্য, মোবাইল ফোন, উদ্ধার হওয়া ব্যাংকের চেকসহ বিভিন্ন আলামতের ভিত্তিতে একের পর এক চক্রের সদস্যের নাম বেরিয়ে আসে। ধারাবাহিক অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান আমাদের সময়কে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় কারাগারে আটক ১১ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে চেয়ে আজ বৃহস্পতিবার আদালতে আবেদন করা হবে। জানা গেছে, পিএসসির সদস্য ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশ্নফাঁস ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অনেক পুরনো। পিএসসির সাবেক সদস্য অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাফরুল থানার মামলাটি দায়ের করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অধ্যাপক মাহফুজুরের বিরুদ্ধে ২৭তম বিসিাএসের মৌখিক পরীক্ষায় ঘুষ গ্রহণসহ পরীক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। সেই মামলায় মাহফুজুর রহমানের ১৩ বছর সাজাও হয়। ২০০৯ সালের ১৭ জুন তিনি আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠান আদালত।
জানা গেছে, পিএসসির গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর বিরুদ্ধেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ অনেক পুরনো। ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল ‘সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদের পরীক্ষা চলাকালে আবদুর রহমান নামের এক পরীক্ষার্থীকে লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ হাতেনাতে আটক করেন পরীক্ষকরা। সেই মামলার অভিযোগপত্র জমা হলেও একদশকে বিচার শেষ হয়নি। সাজাও হয়নি আবেদ আলীর।
পিএসসি সূত্র জানায়, আবেদ আলী ১৯৯৭ সালে গাড়িচালক হিসেবে পিএসসিতে যোগাদান করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার ঢাকার আদালতে ৬ জনের দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসে চাকরি পাওয়া অনেকের নাম বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে কয়েকজন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাও রয়েছেন। এর মধ্যে পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমানের দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষার ১০ জন প্রার্থীর কাছে প্রশ্নফাঁস করেন খলিল। এর মধ্যে তিনজন বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করছেন।
বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করা অন্তত ৬ জন কর্মকর্তারা সঙ্গে কথা হয় আমাদের সময়ের। তারা বলেন, কয়েকজন অপরাধীর দায় মেধাবীরা নেবে কেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসে যারা চাকরি পেয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এখানে রাখঢাক করার কিছু নেই। ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রতি সম্মান ও আস্থা ফেরাতেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আসা উচিত এসব কর্মকর্তাদের।
পিএসসি সূত্র জানিয়েছে, প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের ধরতে নিজেদের গঠিত তদন্ত কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করছে। পিএসসির প্রশ্ন প্রণয়নকারীসহ সংশ্লিষ্ট কাউকে সন্দেহের বাইরে রাখা হচ্ছে না। পিএসসির তদন্ত কমিটির প্রধান পিএসসির যুগ্ম সচিব ড. আব্দুল আলীম বলেন, তদন্তকাজ সম্পন্ন করতে ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। যেসব ইস্যু নিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করছি।
প্রসঙ্গত, গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আলোচিত গাড়িচালক আবেদ আলী ও তার ছেলে সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের মধ্যে পিএসসির দুজন উপপরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালকসহ পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
কখনো পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ছিলেন না আবেদ আলী : পিএসসির চাকরিচ্যুত গাড়িচালক গ্রেপ্তারকৃত সৈয়দ আবেদ আলী কখনো পিএসসির কোনো চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ছিলেন না বলে পিএসসি সূত্র জানিয়েছে। তবে কর্মজীবনে তিনি কমিশনের তিনজন সদস্য ও একজন যুগ্ম সচিবের গাড়িচালক ছিলেন। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসির) সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালে যোগদানের পর থেকে সৈয়দ আবেদ আলী (জীবন) পিএসির সদস্য মজিবুর রহমান বিশ্বাস, মো. মোজাম্মেল হক, মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাত এবং একজন যুগ্মসচিবের গাড়িচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জানা গেছে, অধ্যাপক ড. মো. মুস্তফা চৌধুরী পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৮-২০০২ সাল পর্যন্ত। এ সময় তার গাড়িচালক ছিলেন আলমগীর হোসেন। ২০০২-২০০৭ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান পদে থাকা অধ্যাপক ড. জিনাতুন নেসা তাহমিদা বেগমের গাড়িচালকও ছিলেন আলমগীর হোসেন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. সা’দত হুসাইন। তার সময়েও আলমগীর হোসেনই গাড়িচালক ছিলেন। তারপর নিয়োগ পাওয়া ইকরাম আহমেদের গাড়িচালক ছিলেন আবু বক্কর সিদ্দিক। এর পরের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিকের গাড়িচালক ছিলেন মোট তিনজন। তারা হলেন আবু বক্কর সিদ্দিক, শহিদ ও অনুত্তর চাকমা। পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইনের গাড়িচালক হিসেবে বর্তমানে কর্মরত অনুত্তর চাকমা।
দুদকে পিএসসির চিঠি : সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। গতকাল বুধবার বিকালে পিএসসি থেকে দুদকের সচিব বরাবর এ চিঠি পাঠানো হয়। পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এসএম মতিউর রহমান চিঠি পাঠানো কথা স্বীকার করেন। এ পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেন, পিএসপির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক এসএম আলমগীর কবির, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ, পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্নপত্র প্রকাশ এবং বিতরণ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসেবে অপরাধ সংঘটনে জড়িত থাকার অভিযোগে কর্ম কমিশনের ৫ জনসহ অন্যান্যকে আসামি করে পল্টন থানার মামলা হয়েছে। তারা বর্তমানে জেলে আছেন। তারা ও তাদের পরিবারের সদস্যের নামে অসাধু উপায়ে অর্জিত ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর তফসিলভুক্ত অপরাধ হওয়ায় কমিশন কর্তৃক তদন্তপূর্বক উপযুক্ত আদালতে বিচারার্থ মামলা দায়ের করার লক্ষ্যে সাক্ষ্য প্রমাণাদি সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।