সকল মুসলিম কে ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার দ্বায়িত্ব রাষ্ট্রীয় ভাবে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হউক

#
news image

আমারা সবাই  ইলমে দ্বীন শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জানি কিন্তু এই শিক্ষা গ্রহণ করা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না মুসলিম হওয়া স্বত্বেও।
সামাজিক ও আধুনিক চিন্তাভাবনা কে দ্বায়ী মনে করা হলেও ভুল হবে না!

তবে ইলমে দ্বীন শিক্ষা গ্রহণের ফলে সামাজিক অনেক সমস্যা-ই সৃষ্টি হতো না ইসলাম নিয়ে ভুল বোঝার সুযোগ থাকতো খুবই কম। আমরা যে বিষয় গুলো সম্পর্কে স্বল্প জ্ঞান রাখি সেই সকল বিষয় নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয় বেশি।

ভালো ভাবে সঠিক বিষয় গুলো সবার জানা থাকলে মতপার্থক্য থাকলেও জটিল কোনো সমস্যা সৃষ্টি হতো না যেহেতু মূল বিষয় গুলো সম্পর্কে সবার কাছে একই জ্ঞান রয়েছে। তাছাড়া ইলমে দ্বীন শিক্ষা সবার মধ্যে উপস্থিত থাকার ফলে সবার চিন্তাভাবনা একই ধরনের হতো।

আবেগ অনুভূতি গুলোর মধ্যে মিল থাকার ফলে সবার মধ্যে আরও সুন্দর সম্পর্ক তৈরী হতো যা সমাজে শান্তি বিরাজমান থাকার নিয়ামক হিসেবে কজ করতো। সামাজিক সমস্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ জ্ঞানের তারতম্য এবং ইলমে দ্বীন শিক্ষার অনুপস্থিতি। সঠিক জ্ঞান সমাজে ফিরিয়ে আনতে পারে শান্তি।

ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেওয়ার গুরুত্ব :

১. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
’দ্বীনী ইলম তালাশ করা(অর্থাৎ তা অর্জনের চেষ্টা করা) প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয।’(ইবনু মাজা)

ফায়দাঃ এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, প্রত্যেক মুসলমানের উপর –সে পুরুষ হোক কিংবা নারী, শহরে হোক কিংবা গ্রাম্য, ধনী হোক অথবা দরিদ্র- দ্বীনী ইলম অর্জন করা ফরয।’ দ্বীনী ইলমের অর্থ এই নয় যে, তাকে আরবীতেই পড়তে হবে। বরং এর উদ্দেশ্য হলো, তাকে দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা করতে হবে। আরবী কিতাব পড়ে হোক, উর্দু কিতাব পড়ে হোক(বা বাংলা কিতাব পড়ে হোক), বা নির্ভরযোগ্য আলেমের নিকট জিজ্ঞাসা করে হোক, বা নির্ভরযোগ্য বক্তাদের দ্বারা ওয়ায করিয়ে হোক। যে সমস্ত নারী নিজে পড়তে কিংবা কোন আলেমের নিকট যেতে সক্ষম নয় তারা পুরুষ আপনজনদের দ্বারা আলেমদের থেকে ধর্মীয় বিষয় জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন।

২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু যর (রাযি.) কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন-

’হে আবু যর! (আবু যর একজন সাহাবীর নাম) তুমি কোথাও গিয়ে যদি কুরআনের একটি আয়াত শিক্ষা করো তাহলে তা তোমার জন্য একশ’ রাকআত(নফল) পড়ার চেয়ে উত্তম। আর যদি তুমি কোথাও গিয়ে (দ্বীনী) ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা করো-তার উপর আমল হোক চাই না হোক- তা তোমার জন্য হাজার রাকআত (নফল) পড়ার চেয়ে উত্তম।’(ইবনু মাজা)

এ হাদীস দ্বারা ইলমে দ্বীন শিক্ষা করার অনেক বড় ফযীলত প্রমাণিত হয় এবং এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, কতিপয় লোক বলে থাকে যে, যখন আমল করা গেলো না তাহলে জিজ্ঞাসা করা ও শিক্ষা করার দ্বারা ফায়দা কি? তাদের এ কথা ভুল। লক্ষ্য করুন! এ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিস্কার করে বলেছেন যে, আমল হোক চাই না হোক উভয় অবস্থায় এ মর্যাদা লাভ হবে। এর তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ তো এই যে, দ্বীনের সঠিক বিষয় যেহেতু জানতে পারলো তাই পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে সে বেঁচে থাকবে। আর এটিও অনেক বড় দৌলত। দ্বিতীয় কারণ এই যে, যখন দ্বীনী ইলম জানা থাকবে, তখন ইনশাআল্লাহ তাআলা কখনো না কখনো আমল করারও তাওফীক হবে। তৃতীয় কারণ এই যে, সে অন্যকে তা শিক্ষা দিবে। এরওপ্রয়োজন রয়েছে এবং এটিও সওয়াবের কাজ।

৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

’সর্বোত্তম দান এই যে, একজন মুসলমান ব্যক্তি ইলম (দ্বীনের কোন বিষয়) শিক্ষা করবে, তারপর তা নিজের মুসলমান ভাইকে শিক্ষা দিবে।
(ইবনু মাজা)
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, দ্বীনের যে বিষয় জানা আছে তা অন্য মুসলমান ভাইকেও শিক্ষা দিবে। এর সওয়াব সমস্ত দান-খয়রাতের চেয়ে অধিক।

সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহর কত বড় দয়া, কত বড় অনুগ্রহ যে, সামান্য মুখ নাড়ালে হাজার হাজার টাকা দান করার চেয়ে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়।

৪. মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-

’হে ঈমানদারগণ! নিজকে এবং নিজের পরিবারবর্গকে দোযখ থেকে বাঁচাও’(সূরা আত-তাহরীম-৬)

এ আয়াতের তাফসীরে হযরত আলী (রাযিঃ) বলেন-

’নিজের পরিবারের লোকদেরকে কল্যাণ (অর্থাৎ দ্বীনের বিষয়) শিক্ষা দাও। (হাকীম)

এ হাদীস দ্বারা জানা গেলো যে, নিজের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে দ্বীনী ইলম শিক্ষা দেওয়া ফরয। অন্যথায় পরিণামে দোযখে যেতে হবে। (উপরোক্ত হাদীসসমূহ ‘তারগীব’ কিতাব থেকে সংগৃহীত)

৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

’ঈমানদারের আমল ও সৎকর্মের মধ্য থেকে যেসব বস্ত্ত তার মৃত্যুর পরও তার নিকট পৌছতে থাকে এগুলোও তার অন্তর্ভুক্ত। এক. (দ্বীনী) ইলম, যা শেখানো হয়েছে (অর্থাৎ, কাউকে পড়িয়েছে বা মাসআলা বলে দিয়েছে) বা ইলমের প্রসার ঘটিয়েছে। যেমন ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেছে, বা এ জাতীয় কিতাব খরিদ করে ওয়াকফ করেছে, বা তালিবে ইলমদেরকে দান করেছে বা তালিবে ইলমদের খাদ্য-বস্ত্রে সহযোগিতা করেছে। যাদের মাধ্যমে ইলমে দ্বীনের প্রসার ঘটবে(আর এ ব্যক্তিও তাদেরকে সাহায্য করে এই প্রসারের কাজে অংশীদার হলো)।দুই. নেক সন্তান। যাকে রেখে মৃত্যুবরণ করল। তিন. পবিত্র কুরআনের উত্তরাধিকার রেখে গেলো।’ (ইবনু মাজা ও বাইহাকী)

৬. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

’কোন পিতা তার সন্তানকে এমন কোন জিনিস দেয়নি যা উত্তম শিষ্টাচার (অর্থাৎ, ইলম) থেকে শ্রেষ্ঠ।’(তিরমিযী, বাইহাকী)

৭. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

’যে ব্যক্তি তিনটি মেয়ের বা তিনজন বোনের ভরণপোষণ করবে(অর্থাৎ, তাদের প্রতিপালনের দায়িত্ব নিবে) তারপর তাদেরকে শিষ্টাচার(ইলম) শিক্ষা দিবে এবং তাদের প্রতি সদয় হবে। এমন কি আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিশ্চিন্ত করে দিবেন (অর্থাৎ, তাদের বিবাহ হয়ে যাবে, যার ফলে তারা প্রতিপালনের ব্যাপারে চিন্তামুক্ত হবে)আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে দিবেন। এক ব্যক্তি দু’জন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। তিনি বললেনঃ দু’জনের ক্ষেত্রেও একই ফযীলত রয়েছে। আরেক ব্যক্তি একজন সম্পর্কে জিজ্ঞসা করলো। তিনি বললেন, একজনের বেলায়ও এই ফযীলত রয়েছে।’ (শরহুস সুন্নাহ)

এ হাদীসগুলো মেসকাত শরীফ থেকে সংগৃহীত।

ফায়দাঃ উক্ত হাদীসসমূহে এবং একইভাবে আরো অনেক হাদীসে দ্বীনী ইলম শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেওয়ার সওয়াব এবং তা ফরয হওয়ার বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। ইলমে দ্বীন শেখা ও শেখানোর আসল পরিমাণ তো ঐটিই, যার দ্বারা মানুষ আলেম হয়। কিন্ত্ত সবার এতটুকু সাহস এবং এতটুকু সুযোগ হয়না। তাই আমি দ্বীন শেখা ও শেখানোর সহজ পন্থাসমূহ বলে দিচ্ছি। যার দ্বারা সাধারণ মানুষও এই ফরয আদায় করে সওয়াব লাভ করতে পারবে। সেই পন্থাসমূহের বিস্তারিত বিবরণ এই-

১.যে সমস্ত লোক উর্দু বর্ণ চেনে এবং পড়তে পারে বা সহজে উর্দু পড়া শিখতে পারে তারা উর্দু ভাষায় দ্বীনের নির্ভরযোগ্য যে সমস্ত কিতাব রয়েছে- যেমন, ‘বেহেশতী যেওর’, ‘বেহেশতী গাওহার’, ‘তা’লীমুদ্দীন’, ‘কসদুস সাবীল’, ‘তাবলীগে দ্বীন’ ও ‘তাসহীলুল মাওয়ায়িযের’ ওয়াজসমূহ- এ সমস্ত কিতাবকে কোন ভাল আলেম ব্যক্তির নিকট থেকে সবক আকারে শিখবে। এমন পড়ানেওয়ালা ব্যক্তি না পাওয়া গেলে এ সমস্ত কিতাব নিজে নিজে পড়তে থাকবে।যেখানে বুঝে আসবে না কিংবা কোন সন্দেহ দেখা দিবে সেখানে পেন্সিল প্রভৃতি দ্বারা দাগ দিয়ে রাখবে। তারপর যখন ভালো আলিম ব্যক্তি পাওয়া যাবে, তখন তার কাছে জিজ্ঞাসা করে বুঝে নিবে। এভাবে যেটুকু ইলম লাভ হবে, তা মসজিদ বা বৈঠকে বসে অন্যদেরকেও পড়ে শোনাবে। বাড়ীতে এসে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে শোনাবে। একইভাবে যারা মসজিদে বা বৈঠকে শুনেছে তারাও কথাগুলোকে ভালোভাবে স্মরণ রাখার চেষ্টা করবে এবং যতটুকু স্মরণ থাকে তা বাড়ীতে এসে বাড়ীর লোকদেরকে শোনাবে।

২. যে সমস্ত লোক উর্দু পড়তে সক্ষম নয় তারা কোন ভালো আলিমকে নিজেদের এখানে নিয়ে এসে তার থেকে পূর্বোক্ত কিতাবসমূহ পাঠ করিয়ে শুনবে এবং দ্বীনের বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞাসা করে জেনে নিবে। যদি সবসময় থাকার মত এমন ব্যক্তি পাওয়া যায় তাহলে তো খুবই ভালো। যদি তাকে কিছু বেতনও দিতে হয় তাহলে সবাই অল্প অল্প চাঁদা দিয়ে তাকে বেতনও দিবে। দুনিয়ার জন্য অপ্রয়োজনীয় অনেক কাজে শত-শত হাজার-হাজার টাকা ব্যয় করে থাকো, যদি দ্বীনের জরুরী বিষয়ের জন্য অল্প কিছু টাকা ব্যয় করো তাহলে তা বড় কোন বিষয় নয়। তবে এমন ব্যক্তি- যে তোমাদেরকে দ্বীন শেখাবে-এবং এমন কিতাবসমূহ নিজের বুদ্ধিতে নির্ধারণ করবেনা, বরং কোন ভালো আল্লাহ ওয়ালা আলিম থেকে পরামর্শ নিয়ে নির্ধারণ করবে।

৩. দুনিয়া বা দ্বীনের এমন কোন কাজ করতে হলে, যা শরীয়তে ভালো না মন্দ তা তোমার জানা নাই, তাহলে তা স্মরণ রেখে কোন আল্লাহ ওয়ালা আলিমের নিকট অবশ্যই জিজ্ঞাসা করে নিবে এবং তিনি যা বলেন তা ভালোভাবে স্মরণ রেখে অন্যান্য পুরুষ ও নারীকেও বলবে। আর যদি এ রকম আলিমের নিকট যাওয়ার সুযোগ না থাকে তাহলে তার নিকট চিঠি লিখে জিজ্ঞাসা করবে। চিঠির উত্তরের জন্য একটি খামের উপর নাম ঠিকানা নিজে লিখে বা অন্যের দ্বারা লিখিয়ে চিঠির মধ্যে দিয়ে দিবে। এতে করে ঐ আলিমের উত্তর দেওয়া সহজ হবে এবং তাড়াতাড়ি উত্তর আসবে।

৪. মাঝে মাঝে আল্লাহওয়ালা আলিমদের সঙ্গে সাক্ষাত করবে। তাদের সাহচর্যে বসবে। শুধু এ ইচ্ছা নিয়ে গেলে তো খুবই ভালো, আর যদি এমন ‍সুযোগ না থাকে এবং এমন আলিমও নিকটে না থাকে- যেমন গ্রাম্য লোকেরা শহর থেকে দূরে এক প্রান্তে পড়ে থাকে- তাহলে যখনই কোন কাজের জন্য শহরে যাবে সেখানে এমন কোন আলিম থাকলে কিছু সময়ের জন্য তার সোহবতে বসবে এবং কোন কথা স্মরণ হলে তা জিজ্ঞাসা করবে।

৫. এ কাজটি জরুরী মনে করে করবে যে, কখনো কখনো মাস/দু’মাস পর পর কোন আলিমের পরামর্শে কোন বক্তাকে নিজেদের গ্রাম বা মহল্লায় ডেকে এনে তার ওয়াজ শুনবে। এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার মুহাব্বত ও ভয় অন্তরে জন্মাবে। এর ফলে দ্বীনের উপর আমল করা সহজ হবে।

দ্বীন শিক্ষার পদ্ধতিসমূহের এটি অতি সহজ ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ। নিয়মতান্ত্রিকভাবে এ সমস্ত পন্থা চালু রাখলে দ্বীনের জরুরী বিষয়সমূহের জ্ঞান বিনা পরিশ্রমে অর্জিত হবে। এর সঙ্গে দুটি বিষয় গুরুত্বের সাথে পরিহার করে চলবে।
এক. কাফির ও গোমরাহ লোকদের সভা-সমাবেশে কখনই যাবেনা। কারণ, একে তো কুফরী ও গোমরাহীর কথা কানে পড়লে অন্তরে অন্ধকার সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, অনেক সময় ঈমানের আবেগে এমন কাজ দেখলে ক্রোধের উদ্রেক হয়, আর ক্রোধ প্রকাশ করলে কখনো কখনো বিবাদ সৃষ্টি হয়। যার ফলে অনেক সময় দুনিয়ারও ক্ষতি হয়। অনেক সময় মামলা মোকদ্দমা আরম্ভ হয়। যার মধ্যে সময় এবং টাকা উভয়টিই ব্যয় হয়। যার ফলে পেরেশানী হয়, আর যদি ক্রোধ প্রকাশ না করে তাহলে মনে মনেই কষ্ট ও অশান্তি সৃষ্টি হয়। অনর্থক বসে বসে এই দুঃখ ক্রয় করায় কি ফায়দা।

দ্বিতীয় বিষয় এই যে, কারো সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হবে না। কারণ, তাতেও অধিকাংশ সময় উপরোক্ত অকল্যাণই হয়ে থাকে। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতি এই যে, এমন সমস্ত বৈঠকে যাওয়ার দ্বারা বা বিতর্ক করার দ্বারা কৃফরী ও গোমরাহীর এমন কথা কানে পড়ে, যার দ্বারা নিজে নিজেই সন্দেহ সৃষ্টি হয়। আর নিজের কাছে এই পরিমাণ ইলম নেই, যা তার অন্তর থেকে ঐ সন্দেহ দূর করতে পারে। তাই এমন কাজ কেন করবে যার দ্বারা এতবড় ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। আর যদি কেউ অনর্থক বিতর্ক শুরু করে দেয় তাহলে কঠোরভাবে বলে দিবে যে, আমার সঙ্গে এ ধরনের কথা বলবেনা। তোমার যদি জিজ্ঞাসা করা জরুরীই হয়ে থাকে তাহলে আলেমদের নিকট জিজ্ঞাসা করো। এসব বিষয়ের প্রতি যদি লক্ষ্য রাখেন, তাহলে ঔষধ ও ক্ষতিকর জিনিস থেকে বেঁচে চলার এই উভয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার দ্বারা ইনশাআল্লাহ দ্বীনের ব্যাপারে সবসময় সুস্থ সবল থাকবে। কখনো দ্বীন সংক্রান্ত রোগ সৃষ্টি হবে না। আল্লাহ তায়ালা তাওফীক দান করুন।
হাদিসে এসেছে, ‘প্রতিটি মুসলমানের ওপর ইলম শিক্ষা করা ফরজ।’ (ইবনে মাজা : ২২৪)।
"আসুন ইলমে দ্বীন শিক্ষা গ্রহণ করি,সুন্দর জীবন গড়ি"

ইসলামে ইলমের গুরুত্ব :

ইসলামে ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিমের প্রতি ইসলামের প্রথম বার্তাই- اِقْرَاْ- পড়, ইলম অর্জন কর। ইসলাম থেকে ইলমকে আলাদা করা অসম্ভব। ইসলামের প্রতিটি অংশের মধ্যেই ইলম বিরাজমান। ইলম ছাড়া যথাযথভাবে ইসলাম পালন সম্ভব নয়। ইলম ছাড়া ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন- কোনো ক্ষেত্রেই সত্যিকার অর্থে ইসলাম পালন সম্ভব নয়। তাবেঈ উমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহ. বলেন-

من عمل على غير علم كان ما يفسد أكثر مما يصلح.

যে ব্যক্তি ইলম ছাড়া আমল করবে সে  সঠিকভাবে যতটুকু করবে না করবে, বরবাদ করবে তার চেয়ে বেশি। -তারীখে তাবারী ৬/৫৭২

দ্বীনী ইলমের বিভিন্ন স্তর ও ভাগ রয়েছে। একটি ভাগ ফরযে আইন ও ফরযে কেফায়া হিসাবে। ফরযে আইন বলা হয়, যা শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। বিশেষভাবে এই প্রকারের ইলমের ব্যাপারেই হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ.

প্রত্যেক মুসলিমের উপর ইলম অর্জন করা ফরয। -মুসনাদে আবু হানীফা (হাছকাফী), হাদীস ১, ২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২২৪

ঈমান-আকীদা, ইবাদাত-বন্দেগী, মুআমালাত-মুআশারাতসহ ইসলামের বড় বড় সকল অধ্যায়ের অনেক বিষয়ই এই প্রকারের ইলমের মধ্যে শামিল, যা সকলকেই শিখতে হবে। এই পরিমাণ ইলম শিখে নেওয়া প্রত্যেকের কর্তব্য। আর অধীনস্তদেরকে শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। এ পরিমাণ ইলম না শিখলে আল্লাহর কাছে অন্যকে দায়ী করা যাবে না এবং কোনো ওজরও গ্রহণযোগ্য হবে না।

দ্বিতীয় প্রকারের ইলম হচ্ছে, ফরযে কেফায়া, যা স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরয না হলেও সামষ্টিকভাবে সকলের উপর ফরয। অর্থাৎ সমাজের কিছু ব্যক্তি তা হাসিল করলে সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে। আর কেউই হাসিল না করলে সকলেই দায়ী থাকবে। এ প্রকারের ইলম অনেক বিস্তৃত। এককথায় দ্বীনের সকল বিষয়ের গভীর জ্ঞান। যেহেতু এটি সামষ্টিকভাবে সকলের উপরই ফরয তাই সকলকেই এই দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন থাকা চাই। কেউ যেন মনে না করে, এটি কেবল অমুক শ্রেণির দায়িত্ব। এই ইলমের ব্যাপারেই হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

يَحْمِلُ هَذَا الْعِلْمَ مِنْ كُلِّ خَلَفٍ عُدُولُهُ، يَنْفُونَ عَنْهُ تَحْرِيفَ الْغَالِينَ، وَانْتِحَالَ الْمُبْطِلِينَ، وَتَأْوِيلَ الْجَاهِلِينَ.

এই ইলমকে ধারণ করবে প্রত্যেক উত্তর প্রজন্মের আস্থাভাজন শ্রেণি। তাঁরা একে মুক্ত রাখবে সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি থেকে, বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচার থেকে এবং মূর্খদের অপব্যাখ্যা থেকে। -শরহু মুশকিলিল আছার, হাদীস, ৩৮৮৪; শারাফু আসহাবিল হাদীস, খতীব বাগদাদী, পৃ. ২৯; বুগইয়াতুল মুলতামিস, আলাঈ, পৃ. ৩৪

ইলমকে বলা হয় মাওকূফ আলাইহি অর্থাৎ দ্বীনের প্রতিটি আমল এর উপর নির্ভরশীল। ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীতে একটি শিরোনাম দিয়েছেন-

باب العِلمِ قبْلَ القوْلِ والعملِ.

(সকল কথা ও আমলের আগে হচ্ছে সেই বিষয়ের ইলম।)

এই কারণে হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রাহ. বলেছেন, যে আমলের যে হুকুম তার ইলম হাসিল করারও একই হুকুম। অর্থাৎ যেই আমলটি ইসলামে ফরয তার ইলম অর্জনও ফরয। যেটা ওয়াজিব তার ইলম অর্জন করাও ওয়াজিব। যেটা সুন্নত তার ইলম অর্জনও সুন্নত। তদ্রƒপ যেটা হারাম তার ইলম অর্জন করা ফরয। যা মাকরূহে তাহরীমী তার ইলম অর্জন করা ওয়াজিব। এককথায় ইসলামের যেই বিষয়টি যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়ের ইলম অর্জন করাও তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সঠিক ইলম ছাড়া সঠিক আমল কখনোই সম্ভব নয়।

তৌফিক সুলতান, শিক্ষক, আল ইত্তেহাদ ইসলামি একাডেমি

নাগরিক ডেস্ক

১৫ জুলাই, ২০২৩,  8:02 PM

news image

আমারা সবাই  ইলমে দ্বীন শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জানি কিন্তু এই শিক্ষা গ্রহণ করা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না মুসলিম হওয়া স্বত্বেও।
সামাজিক ও আধুনিক চিন্তাভাবনা কে দ্বায়ী মনে করা হলেও ভুল হবে না!

তবে ইলমে দ্বীন শিক্ষা গ্রহণের ফলে সামাজিক অনেক সমস্যা-ই সৃষ্টি হতো না ইসলাম নিয়ে ভুল বোঝার সুযোগ থাকতো খুবই কম। আমরা যে বিষয় গুলো সম্পর্কে স্বল্প জ্ঞান রাখি সেই সকল বিষয় নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয় বেশি।

ভালো ভাবে সঠিক বিষয় গুলো সবার জানা থাকলে মতপার্থক্য থাকলেও জটিল কোনো সমস্যা সৃষ্টি হতো না যেহেতু মূল বিষয় গুলো সম্পর্কে সবার কাছে একই জ্ঞান রয়েছে। তাছাড়া ইলমে দ্বীন শিক্ষা সবার মধ্যে উপস্থিত থাকার ফলে সবার চিন্তাভাবনা একই ধরনের হতো।

আবেগ অনুভূতি গুলোর মধ্যে মিল থাকার ফলে সবার মধ্যে আরও সুন্দর সম্পর্ক তৈরী হতো যা সমাজে শান্তি বিরাজমান থাকার নিয়ামক হিসেবে কজ করতো। সামাজিক সমস্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ জ্ঞানের তারতম্য এবং ইলমে দ্বীন শিক্ষার অনুপস্থিতি। সঠিক জ্ঞান সমাজে ফিরিয়ে আনতে পারে শান্তি।

ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেওয়ার গুরুত্ব :

১. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
’দ্বীনী ইলম তালাশ করা(অর্থাৎ তা অর্জনের চেষ্টা করা) প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয।’(ইবনু মাজা)

ফায়দাঃ এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, প্রত্যেক মুসলমানের উপর –সে পুরুষ হোক কিংবা নারী, শহরে হোক কিংবা গ্রাম্য, ধনী হোক অথবা দরিদ্র- দ্বীনী ইলম অর্জন করা ফরয।’ দ্বীনী ইলমের অর্থ এই নয় যে, তাকে আরবীতেই পড়তে হবে। বরং এর উদ্দেশ্য হলো, তাকে দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা করতে হবে। আরবী কিতাব পড়ে হোক, উর্দু কিতাব পড়ে হোক(বা বাংলা কিতাব পড়ে হোক), বা নির্ভরযোগ্য আলেমের নিকট জিজ্ঞাসা করে হোক, বা নির্ভরযোগ্য বক্তাদের দ্বারা ওয়ায করিয়ে হোক। যে সমস্ত নারী নিজে পড়তে কিংবা কোন আলেমের নিকট যেতে সক্ষম নয় তারা পুরুষ আপনজনদের দ্বারা আলেমদের থেকে ধর্মীয় বিষয় জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন।

২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু যর (রাযি.) কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন-

’হে আবু যর! (আবু যর একজন সাহাবীর নাম) তুমি কোথাও গিয়ে যদি কুরআনের একটি আয়াত শিক্ষা করো তাহলে তা তোমার জন্য একশ’ রাকআত(নফল) পড়ার চেয়ে উত্তম। আর যদি তুমি কোথাও গিয়ে (দ্বীনী) ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা করো-তার উপর আমল হোক চাই না হোক- তা তোমার জন্য হাজার রাকআত (নফল) পড়ার চেয়ে উত্তম।’(ইবনু মাজা)

এ হাদীস দ্বারা ইলমে দ্বীন শিক্ষা করার অনেক বড় ফযীলত প্রমাণিত হয় এবং এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, কতিপয় লোক বলে থাকে যে, যখন আমল করা গেলো না তাহলে জিজ্ঞাসা করা ও শিক্ষা করার দ্বারা ফায়দা কি? তাদের এ কথা ভুল। লক্ষ্য করুন! এ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিস্কার করে বলেছেন যে, আমল হোক চাই না হোক উভয় অবস্থায় এ মর্যাদা লাভ হবে। এর তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ তো এই যে, দ্বীনের সঠিক বিষয় যেহেতু জানতে পারলো তাই পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে সে বেঁচে থাকবে। আর এটিও অনেক বড় দৌলত। দ্বিতীয় কারণ এই যে, যখন দ্বীনী ইলম জানা থাকবে, তখন ইনশাআল্লাহ তাআলা কখনো না কখনো আমল করারও তাওফীক হবে। তৃতীয় কারণ এই যে, সে অন্যকে তা শিক্ষা দিবে। এরওপ্রয়োজন রয়েছে এবং এটিও সওয়াবের কাজ।

৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

’সর্বোত্তম দান এই যে, একজন মুসলমান ব্যক্তি ইলম (দ্বীনের কোন বিষয়) শিক্ষা করবে, তারপর তা নিজের মুসলমান ভাইকে শিক্ষা দিবে।
(ইবনু মাজা)
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, দ্বীনের যে বিষয় জানা আছে তা অন্য মুসলমান ভাইকেও শিক্ষা দিবে। এর সওয়াব সমস্ত দান-খয়রাতের চেয়ে অধিক।

সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহর কত বড় দয়া, কত বড় অনুগ্রহ যে, সামান্য মুখ নাড়ালে হাজার হাজার টাকা দান করার চেয়ে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়।

৪. মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-

’হে ঈমানদারগণ! নিজকে এবং নিজের পরিবারবর্গকে দোযখ থেকে বাঁচাও’(সূরা আত-তাহরীম-৬)

এ আয়াতের তাফসীরে হযরত আলী (রাযিঃ) বলেন-

’নিজের পরিবারের লোকদেরকে কল্যাণ (অর্থাৎ দ্বীনের বিষয়) শিক্ষা দাও। (হাকীম)

এ হাদীস দ্বারা জানা গেলো যে, নিজের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে দ্বীনী ইলম শিক্ষা দেওয়া ফরয। অন্যথায় পরিণামে দোযখে যেতে হবে। (উপরোক্ত হাদীসসমূহ ‘তারগীব’ কিতাব থেকে সংগৃহীত)

৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

’ঈমানদারের আমল ও সৎকর্মের মধ্য থেকে যেসব বস্ত্ত তার মৃত্যুর পরও তার নিকট পৌছতে থাকে এগুলোও তার অন্তর্ভুক্ত। এক. (দ্বীনী) ইলম, যা শেখানো হয়েছে (অর্থাৎ, কাউকে পড়িয়েছে বা মাসআলা বলে দিয়েছে) বা ইলমের প্রসার ঘটিয়েছে। যেমন ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেছে, বা এ জাতীয় কিতাব খরিদ করে ওয়াকফ করেছে, বা তালিবে ইলমদেরকে দান করেছে বা তালিবে ইলমদের খাদ্য-বস্ত্রে সহযোগিতা করেছে। যাদের মাধ্যমে ইলমে দ্বীনের প্রসার ঘটবে(আর এ ব্যক্তিও তাদেরকে সাহায্য করে এই প্রসারের কাজে অংশীদার হলো)।দুই. নেক সন্তান। যাকে রেখে মৃত্যুবরণ করল। তিন. পবিত্র কুরআনের উত্তরাধিকার রেখে গেলো।’ (ইবনু মাজা ও বাইহাকী)

৬. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

’কোন পিতা তার সন্তানকে এমন কোন জিনিস দেয়নি যা উত্তম শিষ্টাচার (অর্থাৎ, ইলম) থেকে শ্রেষ্ঠ।’(তিরমিযী, বাইহাকী)

৭. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

’যে ব্যক্তি তিনটি মেয়ের বা তিনজন বোনের ভরণপোষণ করবে(অর্থাৎ, তাদের প্রতিপালনের দায়িত্ব নিবে) তারপর তাদেরকে শিষ্টাচার(ইলম) শিক্ষা দিবে এবং তাদের প্রতি সদয় হবে। এমন কি আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিশ্চিন্ত করে দিবেন (অর্থাৎ, তাদের বিবাহ হয়ে যাবে, যার ফলে তারা প্রতিপালনের ব্যাপারে চিন্তামুক্ত হবে)আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে দিবেন। এক ব্যক্তি দু’জন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। তিনি বললেনঃ দু’জনের ক্ষেত্রেও একই ফযীলত রয়েছে। আরেক ব্যক্তি একজন সম্পর্কে জিজ্ঞসা করলো। তিনি বললেন, একজনের বেলায়ও এই ফযীলত রয়েছে।’ (শরহুস সুন্নাহ)

এ হাদীসগুলো মেসকাত শরীফ থেকে সংগৃহীত।

ফায়দাঃ উক্ত হাদীসসমূহে এবং একইভাবে আরো অনেক হাদীসে দ্বীনী ইলম শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেওয়ার সওয়াব এবং তা ফরয হওয়ার বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। ইলমে দ্বীন শেখা ও শেখানোর আসল পরিমাণ তো ঐটিই, যার দ্বারা মানুষ আলেম হয়। কিন্ত্ত সবার এতটুকু সাহস এবং এতটুকু সুযোগ হয়না। তাই আমি দ্বীন শেখা ও শেখানোর সহজ পন্থাসমূহ বলে দিচ্ছি। যার দ্বারা সাধারণ মানুষও এই ফরয আদায় করে সওয়াব লাভ করতে পারবে। সেই পন্থাসমূহের বিস্তারিত বিবরণ এই-

১.যে সমস্ত লোক উর্দু বর্ণ চেনে এবং পড়তে পারে বা সহজে উর্দু পড়া শিখতে পারে তারা উর্দু ভাষায় দ্বীনের নির্ভরযোগ্য যে সমস্ত কিতাব রয়েছে- যেমন, ‘বেহেশতী যেওর’, ‘বেহেশতী গাওহার’, ‘তা’লীমুদ্দীন’, ‘কসদুস সাবীল’, ‘তাবলীগে দ্বীন’ ও ‘তাসহীলুল মাওয়ায়িযের’ ওয়াজসমূহ- এ সমস্ত কিতাবকে কোন ভাল আলেম ব্যক্তির নিকট থেকে সবক আকারে শিখবে। এমন পড়ানেওয়ালা ব্যক্তি না পাওয়া গেলে এ সমস্ত কিতাব নিজে নিজে পড়তে থাকবে।যেখানে বুঝে আসবে না কিংবা কোন সন্দেহ দেখা দিবে সেখানে পেন্সিল প্রভৃতি দ্বারা দাগ দিয়ে রাখবে। তারপর যখন ভালো আলিম ব্যক্তি পাওয়া যাবে, তখন তার কাছে জিজ্ঞাসা করে বুঝে নিবে। এভাবে যেটুকু ইলম লাভ হবে, তা মসজিদ বা বৈঠকে বসে অন্যদেরকেও পড়ে শোনাবে। বাড়ীতে এসে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে শোনাবে। একইভাবে যারা মসজিদে বা বৈঠকে শুনেছে তারাও কথাগুলোকে ভালোভাবে স্মরণ রাখার চেষ্টা করবে এবং যতটুকু স্মরণ থাকে তা বাড়ীতে এসে বাড়ীর লোকদেরকে শোনাবে।

২. যে সমস্ত লোক উর্দু পড়তে সক্ষম নয় তারা কোন ভালো আলিমকে নিজেদের এখানে নিয়ে এসে তার থেকে পূর্বোক্ত কিতাবসমূহ পাঠ করিয়ে শুনবে এবং দ্বীনের বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞাসা করে জেনে নিবে। যদি সবসময় থাকার মত এমন ব্যক্তি পাওয়া যায় তাহলে তো খুবই ভালো। যদি তাকে কিছু বেতনও দিতে হয় তাহলে সবাই অল্প অল্প চাঁদা দিয়ে তাকে বেতনও দিবে। দুনিয়ার জন্য অপ্রয়োজনীয় অনেক কাজে শত-শত হাজার-হাজার টাকা ব্যয় করে থাকো, যদি দ্বীনের জরুরী বিষয়ের জন্য অল্প কিছু টাকা ব্যয় করো তাহলে তা বড় কোন বিষয় নয়। তবে এমন ব্যক্তি- যে তোমাদেরকে দ্বীন শেখাবে-এবং এমন কিতাবসমূহ নিজের বুদ্ধিতে নির্ধারণ করবেনা, বরং কোন ভালো আল্লাহ ওয়ালা আলিম থেকে পরামর্শ নিয়ে নির্ধারণ করবে।

৩. দুনিয়া বা দ্বীনের এমন কোন কাজ করতে হলে, যা শরীয়তে ভালো না মন্দ তা তোমার জানা নাই, তাহলে তা স্মরণ রেখে কোন আল্লাহ ওয়ালা আলিমের নিকট অবশ্যই জিজ্ঞাসা করে নিবে এবং তিনি যা বলেন তা ভালোভাবে স্মরণ রেখে অন্যান্য পুরুষ ও নারীকেও বলবে। আর যদি এ রকম আলিমের নিকট যাওয়ার সুযোগ না থাকে তাহলে তার নিকট চিঠি লিখে জিজ্ঞাসা করবে। চিঠির উত্তরের জন্য একটি খামের উপর নাম ঠিকানা নিজে লিখে বা অন্যের দ্বারা লিখিয়ে চিঠির মধ্যে দিয়ে দিবে। এতে করে ঐ আলিমের উত্তর দেওয়া সহজ হবে এবং তাড়াতাড়ি উত্তর আসবে।

৪. মাঝে মাঝে আল্লাহওয়ালা আলিমদের সঙ্গে সাক্ষাত করবে। তাদের সাহচর্যে বসবে। শুধু এ ইচ্ছা নিয়ে গেলে তো খুবই ভালো, আর যদি এমন ‍সুযোগ না থাকে এবং এমন আলিমও নিকটে না থাকে- যেমন গ্রাম্য লোকেরা শহর থেকে দূরে এক প্রান্তে পড়ে থাকে- তাহলে যখনই কোন কাজের জন্য শহরে যাবে সেখানে এমন কোন আলিম থাকলে কিছু সময়ের জন্য তার সোহবতে বসবে এবং কোন কথা স্মরণ হলে তা জিজ্ঞাসা করবে।

৫. এ কাজটি জরুরী মনে করে করবে যে, কখনো কখনো মাস/দু’মাস পর পর কোন আলিমের পরামর্শে কোন বক্তাকে নিজেদের গ্রাম বা মহল্লায় ডেকে এনে তার ওয়াজ শুনবে। এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার মুহাব্বত ও ভয় অন্তরে জন্মাবে। এর ফলে দ্বীনের উপর আমল করা সহজ হবে।

দ্বীন শিক্ষার পদ্ধতিসমূহের এটি অতি সহজ ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ। নিয়মতান্ত্রিকভাবে এ সমস্ত পন্থা চালু রাখলে দ্বীনের জরুরী বিষয়সমূহের জ্ঞান বিনা পরিশ্রমে অর্জিত হবে। এর সঙ্গে দুটি বিষয় গুরুত্বের সাথে পরিহার করে চলবে।
এক. কাফির ও গোমরাহ লোকদের সভা-সমাবেশে কখনই যাবেনা। কারণ, একে তো কুফরী ও গোমরাহীর কথা কানে পড়লে অন্তরে অন্ধকার সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, অনেক সময় ঈমানের আবেগে এমন কাজ দেখলে ক্রোধের উদ্রেক হয়, আর ক্রোধ প্রকাশ করলে কখনো কখনো বিবাদ সৃষ্টি হয়। যার ফলে অনেক সময় দুনিয়ারও ক্ষতি হয়। অনেক সময় মামলা মোকদ্দমা আরম্ভ হয়। যার মধ্যে সময় এবং টাকা উভয়টিই ব্যয় হয়। যার ফলে পেরেশানী হয়, আর যদি ক্রোধ প্রকাশ না করে তাহলে মনে মনেই কষ্ট ও অশান্তি সৃষ্টি হয়। অনর্থক বসে বসে এই দুঃখ ক্রয় করায় কি ফায়দা।

দ্বিতীয় বিষয় এই যে, কারো সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হবে না। কারণ, তাতেও অধিকাংশ সময় উপরোক্ত অকল্যাণই হয়ে থাকে। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতি এই যে, এমন সমস্ত বৈঠকে যাওয়ার দ্বারা বা বিতর্ক করার দ্বারা কৃফরী ও গোমরাহীর এমন কথা কানে পড়ে, যার দ্বারা নিজে নিজেই সন্দেহ সৃষ্টি হয়। আর নিজের কাছে এই পরিমাণ ইলম নেই, যা তার অন্তর থেকে ঐ সন্দেহ দূর করতে পারে। তাই এমন কাজ কেন করবে যার দ্বারা এতবড় ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। আর যদি কেউ অনর্থক বিতর্ক শুরু করে দেয় তাহলে কঠোরভাবে বলে দিবে যে, আমার সঙ্গে এ ধরনের কথা বলবেনা। তোমার যদি জিজ্ঞাসা করা জরুরীই হয়ে থাকে তাহলে আলেমদের নিকট জিজ্ঞাসা করো। এসব বিষয়ের প্রতি যদি লক্ষ্য রাখেন, তাহলে ঔষধ ও ক্ষতিকর জিনিস থেকে বেঁচে চলার এই উভয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার দ্বারা ইনশাআল্লাহ দ্বীনের ব্যাপারে সবসময় সুস্থ সবল থাকবে। কখনো দ্বীন সংক্রান্ত রোগ সৃষ্টি হবে না। আল্লাহ তায়ালা তাওফীক দান করুন।
হাদিসে এসেছে, ‘প্রতিটি মুসলমানের ওপর ইলম শিক্ষা করা ফরজ।’ (ইবনে মাজা : ২২৪)।
"আসুন ইলমে দ্বীন শিক্ষা গ্রহণ করি,সুন্দর জীবন গড়ি"

ইসলামে ইলমের গুরুত্ব :

ইসলামে ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিমের প্রতি ইসলামের প্রথম বার্তাই- اِقْرَاْ- পড়, ইলম অর্জন কর। ইসলাম থেকে ইলমকে আলাদা করা অসম্ভব। ইসলামের প্রতিটি অংশের মধ্যেই ইলম বিরাজমান। ইলম ছাড়া যথাযথভাবে ইসলাম পালন সম্ভব নয়। ইলম ছাড়া ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন- কোনো ক্ষেত্রেই সত্যিকার অর্থে ইসলাম পালন সম্ভব নয়। তাবেঈ উমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহ. বলেন-

من عمل على غير علم كان ما يفسد أكثر مما يصلح.

যে ব্যক্তি ইলম ছাড়া আমল করবে সে  সঠিকভাবে যতটুকু করবে না করবে, বরবাদ করবে তার চেয়ে বেশি। -তারীখে তাবারী ৬/৫৭২

দ্বীনী ইলমের বিভিন্ন স্তর ও ভাগ রয়েছে। একটি ভাগ ফরযে আইন ও ফরযে কেফায়া হিসাবে। ফরযে আইন বলা হয়, যা শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। বিশেষভাবে এই প্রকারের ইলমের ব্যাপারেই হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ.

প্রত্যেক মুসলিমের উপর ইলম অর্জন করা ফরয। -মুসনাদে আবু হানীফা (হাছকাফী), হাদীস ১, ২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২২৪

ঈমান-আকীদা, ইবাদাত-বন্দেগী, মুআমালাত-মুআশারাতসহ ইসলামের বড় বড় সকল অধ্যায়ের অনেক বিষয়ই এই প্রকারের ইলমের মধ্যে শামিল, যা সকলকেই শিখতে হবে। এই পরিমাণ ইলম শিখে নেওয়া প্রত্যেকের কর্তব্য। আর অধীনস্তদেরকে শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। এ পরিমাণ ইলম না শিখলে আল্লাহর কাছে অন্যকে দায়ী করা যাবে না এবং কোনো ওজরও গ্রহণযোগ্য হবে না।

দ্বিতীয় প্রকারের ইলম হচ্ছে, ফরযে কেফায়া, যা স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরয না হলেও সামষ্টিকভাবে সকলের উপর ফরয। অর্থাৎ সমাজের কিছু ব্যক্তি তা হাসিল করলে সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে। আর কেউই হাসিল না করলে সকলেই দায়ী থাকবে। এ প্রকারের ইলম অনেক বিস্তৃত। এককথায় দ্বীনের সকল বিষয়ের গভীর জ্ঞান। যেহেতু এটি সামষ্টিকভাবে সকলের উপরই ফরয তাই সকলকেই এই দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন থাকা চাই। কেউ যেন মনে না করে, এটি কেবল অমুক শ্রেণির দায়িত্ব। এই ইলমের ব্যাপারেই হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

يَحْمِلُ هَذَا الْعِلْمَ مِنْ كُلِّ خَلَفٍ عُدُولُهُ، يَنْفُونَ عَنْهُ تَحْرِيفَ الْغَالِينَ، وَانْتِحَالَ الْمُبْطِلِينَ، وَتَأْوِيلَ الْجَاهِلِينَ.

এই ইলমকে ধারণ করবে প্রত্যেক উত্তর প্রজন্মের আস্থাভাজন শ্রেণি। তাঁরা একে মুক্ত রাখবে সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি থেকে, বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচার থেকে এবং মূর্খদের অপব্যাখ্যা থেকে। -শরহু মুশকিলিল আছার, হাদীস, ৩৮৮৪; শারাফু আসহাবিল হাদীস, খতীব বাগদাদী, পৃ. ২৯; বুগইয়াতুল মুলতামিস, আলাঈ, পৃ. ৩৪

ইলমকে বলা হয় মাওকূফ আলাইহি অর্থাৎ দ্বীনের প্রতিটি আমল এর উপর নির্ভরশীল। ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীতে একটি শিরোনাম দিয়েছেন-

باب العِلمِ قبْلَ القوْلِ والعملِ.

(সকল কথা ও আমলের আগে হচ্ছে সেই বিষয়ের ইলম।)

এই কারণে হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রাহ. বলেছেন, যে আমলের যে হুকুম তার ইলম হাসিল করারও একই হুকুম। অর্থাৎ যেই আমলটি ইসলামে ফরয তার ইলম অর্জনও ফরয। যেটা ওয়াজিব তার ইলম অর্জন করাও ওয়াজিব। যেটা সুন্নত তার ইলম অর্জনও সুন্নত। তদ্রƒপ যেটা হারাম তার ইলম অর্জন করা ফরয। যা মাকরূহে তাহরীমী তার ইলম অর্জন করা ওয়াজিব। এককথায় ইসলামের যেই বিষয়টি যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়ের ইলম অর্জন করাও তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সঠিক ইলম ছাড়া সঠিক আমল কখনোই সম্ভব নয়।

তৌফিক সুলতান, শিক্ষক, আল ইত্তেহাদ ইসলামি একাডেমি