‘ঘটনাচক্রে’ আবিষ্কৃত লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি কমাতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি

#
news image

ভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবনের ঘটনা নতুন কিছু না। ডাইনামাইট, পেনিসিলিন, এক্স-রে মেশিনসহ মাইক্রোওয়েভের মতো বৈপ্লবিক আবিষ্কারগুলো পরিকল্পিতভাবে উদ্ভাবিত হয়নি।

সম্প্রতি এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি। এই আবিষ্কার পরিকল্পিত না হলেও এটি ভবিষ্যতে বিশ্বে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির  ব্যাপক উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু হলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে পৃথিবী বাঁচতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবহারের সূচনা নব্বইয়ের দশকে হলেও আধুনিক জীবন অনেকটাই এর ওপর নির্ভরশীল। কারণ স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি, চিকিৎসা সামগ্রী এমনকি স্যাটেলাইটের শক্তির প্রধান উৎসও এ ব্যাটারি।

বর্তমান সময়ে আমরা লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হলেও এর বহুমুখী মারাত্মক নেতিবাচক দিকের কারণে বিজ্ঞানী, গবেষক, উদ্ভাবক-উদ্যোক্তারা বিকল্প বের করার চেষ্টায় কমতি রাখছেন না।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তৈরির মূল উপাদান কোবাল্ট। কিন্তু কোবাল্ট মাইনিং পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর। একই সঙ্গে তেমনি বাস্তুসংস্থানের স্বাভাবিক ধারা ধ্বংসেও কোবাল্টের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি কাঁচামাল হিসাবে কোবাল্ট দামি হওয়ায় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে যে সব যন্ত্রপাতিতে এ ব্যাটারি ব্যবহৃত হয় সেগুলোর দামের ওপর।

এছাড়া, তুলনামূলক দুর্বল “ডেপথ অব ডিসচার্জ” থাকায় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির স্থায়িত্ব নিয়ে সমস্যাও রয়েছে। ডেপথ অব ডিসচার্জ হলো চার্জ নির্গমন বিবেচনায় প্রতি শতক হারে কোনো ব্যাটারির মোট ধারণক্ষমতার ব্যবহৃত পরিমাণের পরিমাপ। 

যেমন- কোনো ব্যাটারি যদি তার পুরো শক্তিক্ষমতার ২০% হারে ডিসচার্জ করে, আর অন্য আরেকটি ব্যাটারি ৮০% হারে ডিসচার্জ করে, তাহলে ২০% হারে ডিসচার্জ করা ব্যাটারির স্থায়িত্ব ৮০% হারে ডিসচার্জ করা ব্যাটারির তুলনায় বেশি হবে।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির স্থায়িত্ব নিয়ে সমস্যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাপক প্রচলন হওয়ার অন্যতম প্রধান অন্তরায় এ বিষয়টি।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ওজনে ভারি এবং আকারে বড় হওয়ায় এতে ঘনত্ব বা ডেনসিটি স্বল্পতা রয়েছে। এ কারণে বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে মাইলেজ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার মতো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। আবার অতি উন্নত প্রযুক্তির যানবাহন যেমন বাণিজ্যিক বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজ বা জাহাজেও এ ব্যাটারি ব্যবহার সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।

তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির এসব সীমাবদ্ধতা প্রশমন করার ক্ষমতা রয়েছে ষাটের দশকে আবিষ্কার হওয়া লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির। ষাটের দশকে হার্বার্ট এবং উলাম নামের দুই উদ্ভাবক লিথিয়ামকে অ্যানোডিক এবং সালফারকে ক্যাথোডিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি তৈরি করেন। 

কোবাল্টের চেয়ে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি তৈরির ব্যবহৃত মূল উপাদান সালফার তুলনামূলকভাবে জলবায়ুর জন্য কম ক্ষতিকারক। সেই সঙ্গে এ ব্যাটারির উৎপাদন খরচও কম। তাছাড়া, লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির এনার্জি-ডেনসিটি বেশি হওয়ায় তা ওজনে বেশ হালকা হয়।

কিন্তু এতসব সুবিধার পরেও শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে উচ্চ কার্যক্ষমতা হারানোর কারণে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির ব্যাপক ব্যবহার প্রচলিত না। অভ্যন্তরীণ সেই রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে ব্যাটারির আয়ুষ্কালের ওপর প্রভাব পড়ে।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির সঙ্গে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির তুলনা করলে দেখা যায়, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিকে যেখানে ২ হাজার চার্জ সাইকেল পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়, সেখানে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি ব্যবহৃত হতে পারে ১ হাজার চার্জ সাইকেল থেকেও কম সংখ্যকবার। অর্থাৎ ১ বা সর্বোচ্চ ২ বছর ঠিকঠাক ব্যবহার করার পরই লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির জীবনচক্রের পরিসমাপ্তি ঘটে।

এ সীমাবদ্ধতা দূর করতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় অবস্থিত ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির ক্যাথোডের উপাদান পরিবর্তন করে ওই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে হঠাৎ এক আবিষ্কারের দেখা পান। নিরীক্ষাকালীন সময়ে ড্রেক্সেল দলের মূল লক্ষ্য ছিল লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির চার্জ এবং ডিসচার্জের সময় পলিসালফাইড তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে ধীরগতির করে দেওয়া। আর এই পলিসালফাইড সৃষ্টির বিষয়টিই লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির সেই সীমাবদ্ধতা। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট পলিসালফাইড আদতে ইলেকট্রোডে থাকা সালফারকে বের করে আনে এবং যার কারণে ব্যাটারির কার্যক্ষমতা ও সর্বোপরি মেয়াদকাল অনেক কমে যায়।

ড্রেক্সেলের গবেষক দলের পলিসালফাইড তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে শ্লথ করার লক্ষ্য থাকলেও তারা বরং অভিনব এক ঘটনার স্বাক্ষী হয়। তারা নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে সালফারের রাসায়নিক এক দশা সৃষ্টির ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে এবং সালফারের যে রাসায়নিক দশা ব্যাটারির ক্ষয় রোধ করতে সক্ষম।

এমন আবিষ্কার ড্রেক্সেল দলকে বিস্মিত করে তোলে এবং অবিশ্বাস্য এই আবিষ্কার যথাযথ কি-না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে তারা শতবারের বেশি পুনর্নিরীক্ষা চালান। আর প্রতিবারই একই ফলাফল আসতে থাকে।  

সালফারের এমন রাসায়নিক অবস্থার নাম মনোক্লিনিক গামা-ফেইজ সালফার। পূর্বে এই অবস্থার দেখা মিলেছিল শুধু একবারই- তা ঘটেছিল পরীক্ষাগারের অতি উচ্চ তাপমাত্রায় (৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রায়)। কিন্তু কক্ষ তাপমাত্রায় সর্বপ্রথম ওই অবস্থার দেখা পাওয়া গেল।   

লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারিতে মনোক্লিনিক গামা-ফেইজ সালফার পলিসালফাইড তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল এবং তা এতটাই কার্যকরী ছিল যে, গবেষক দল পরীক্ষায় ব্যবহৃত ব্যাটারিকে ৪ হাজার চার্জ সাইকেলের ভেতর দিয়ে নেওয়া স্বত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে তা নিজের কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। যার অর্থ হচ্ছে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির তুলনায় যা দ্বিগুণ বেশি সময় কার্যকরী থাকার সামর্থ্য রাখে।

প্রসঙ্গত, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির তুলনায় ওই ব্যাটারির এনার্জি ডেন্স তিন গুণ বেশি ছিল অর্থাৎ যা চার্জ হতে সময় নিয়েছিল লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির মতো একই সময়। 

ড্রেক্সেল দলের এই সাফল্য অর্থাৎ পলিসালফাইডঘটিত জটিলতা যদি লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি বাণিজ্যিকভাবেও উতরে যেতে পারে তাহলে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির পরিবর্তে হালকা, সস্তা, পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর এবং অধিক কার্যকরী লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি আসন্ন সময়ে স্মার্টফোন, বৈদ্যুতিক গাড়ি থেকে শুরু করে ভবিষ্যত বিশ্বের প্রযুক্তি-সামগ্রীর বিকল্প মূল শক্তির উৎস হয়ে উঠতে পারে। 

কঙ্গোর মতো নাজুক একটি দেশের ওপর লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে ব্যবহৃত উচ্চ মূল্যের উপাদান কোবাল্টের সিংহভাগ যোগান (প্রায় ৭০%) নির্ভর করে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ বা এমনকি ২০২৫ সালের দিকে কোবাল্টের সরবরাহ বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হবে। অন্যদিকে, খুবই সস্তা কাঁচামাল, সহজপ্রাপ্যতা ও উপাদান হিসেবে প্রাচুর্যের বিবেচনায় পৃথিবীর দশম স্থান অধিকার করে আছে সালফার।

এছাড়া, স্পেসিফিক এনার্জি বা ইউনিট প্রতি শক্তি বিবেচনায় আনলে দেখা যায় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির মাত্রা যেখানে মাত্র ১৫০-২৬০ ওয়াট ঘণ্টা/কিলোগ্রাম সেখানে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির মাত্রা তা থেকে দ্বিগুণেরও বেশি (প্রায় ৫৫০ ওয়াট ঘণ্টা/কিলোগ্রাম)।

পাশাপাশি বাণিজ্যিক পরিসরে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি তৈরিতে অতিরিক্ত খরচ পাশ কাটানোরও সুযোগ থাকছে। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত কারখানাই লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি উৎপাদনে ব্যবহার করা যাবে। ফলে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির বাণিজ্যিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নতুনভাবে অবকাঠামো তৈরি করতে হবে না বলে সেই সুযোগ তৈরি হতে পারে। 

তাই ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অকস্মাৎ এ আবিষ্কার সারা পৃথিবীর শক্তির ব্যবহারে বিপ্লব নিয়ে আসতে পারে এবং পৃথিবীকে কার্বনমুক্ত, দূষণ কমিয়ে এক নির্মল পরিবেশ উপহার দিতে পারে। সেজন্য এ উদ্ভাবন যেন গবেষণাগার থেকে অতি দ্রুত সফলভাবে বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে পৌঁছায় এবং ব্যবহৃত হতে শুরু করে, সে ব্যাপারে অপেক্ষা করতে হবে।

প্রভাতী খবর ডেস্ক

২৯ মে, ২০২২,  11:13 PM

news image

ভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবনের ঘটনা নতুন কিছু না। ডাইনামাইট, পেনিসিলিন, এক্স-রে মেশিনসহ মাইক্রোওয়েভের মতো বৈপ্লবিক আবিষ্কারগুলো পরিকল্পিতভাবে উদ্ভাবিত হয়নি।

সম্প্রতি এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি। এই আবিষ্কার পরিকল্পিত না হলেও এটি ভবিষ্যতে বিশ্বে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির  ব্যাপক উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু হলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে পৃথিবী বাঁচতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবহারের সূচনা নব্বইয়ের দশকে হলেও আধুনিক জীবন অনেকটাই এর ওপর নির্ভরশীল। কারণ স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি, চিকিৎসা সামগ্রী এমনকি স্যাটেলাইটের শক্তির প্রধান উৎসও এ ব্যাটারি।

বর্তমান সময়ে আমরা লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হলেও এর বহুমুখী মারাত্মক নেতিবাচক দিকের কারণে বিজ্ঞানী, গবেষক, উদ্ভাবক-উদ্যোক্তারা বিকল্প বের করার চেষ্টায় কমতি রাখছেন না।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তৈরির মূল উপাদান কোবাল্ট। কিন্তু কোবাল্ট মাইনিং পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর। একই সঙ্গে তেমনি বাস্তুসংস্থানের স্বাভাবিক ধারা ধ্বংসেও কোবাল্টের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি কাঁচামাল হিসাবে কোবাল্ট দামি হওয়ায় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে যে সব যন্ত্রপাতিতে এ ব্যাটারি ব্যবহৃত হয় সেগুলোর দামের ওপর।

এছাড়া, তুলনামূলক দুর্বল “ডেপথ অব ডিসচার্জ” থাকায় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির স্থায়িত্ব নিয়ে সমস্যাও রয়েছে। ডেপথ অব ডিসচার্জ হলো চার্জ নির্গমন বিবেচনায় প্রতি শতক হারে কোনো ব্যাটারির মোট ধারণক্ষমতার ব্যবহৃত পরিমাণের পরিমাপ। 

যেমন- কোনো ব্যাটারি যদি তার পুরো শক্তিক্ষমতার ২০% হারে ডিসচার্জ করে, আর অন্য আরেকটি ব্যাটারি ৮০% হারে ডিসচার্জ করে, তাহলে ২০% হারে ডিসচার্জ করা ব্যাটারির স্থায়িত্ব ৮০% হারে ডিসচার্জ করা ব্যাটারির তুলনায় বেশি হবে।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির স্থায়িত্ব নিয়ে সমস্যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাপক প্রচলন হওয়ার অন্যতম প্রধান অন্তরায় এ বিষয়টি।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ওজনে ভারি এবং আকারে বড় হওয়ায় এতে ঘনত্ব বা ডেনসিটি স্বল্পতা রয়েছে। এ কারণে বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে মাইলেজ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার মতো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। আবার অতি উন্নত প্রযুক্তির যানবাহন যেমন বাণিজ্যিক বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজ বা জাহাজেও এ ব্যাটারি ব্যবহার সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।

তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির এসব সীমাবদ্ধতা প্রশমন করার ক্ষমতা রয়েছে ষাটের দশকে আবিষ্কার হওয়া লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির। ষাটের দশকে হার্বার্ট এবং উলাম নামের দুই উদ্ভাবক লিথিয়ামকে অ্যানোডিক এবং সালফারকে ক্যাথোডিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি তৈরি করেন। 

কোবাল্টের চেয়ে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি তৈরির ব্যবহৃত মূল উপাদান সালফার তুলনামূলকভাবে জলবায়ুর জন্য কম ক্ষতিকারক। সেই সঙ্গে এ ব্যাটারির উৎপাদন খরচও কম। তাছাড়া, লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির এনার্জি-ডেনসিটি বেশি হওয়ায় তা ওজনে বেশ হালকা হয়।

কিন্তু এতসব সুবিধার পরেও শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে উচ্চ কার্যক্ষমতা হারানোর কারণে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির ব্যাপক ব্যবহার প্রচলিত না। অভ্যন্তরীণ সেই রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে ব্যাটারির আয়ুষ্কালের ওপর প্রভাব পড়ে।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির সঙ্গে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির তুলনা করলে দেখা যায়, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিকে যেখানে ২ হাজার চার্জ সাইকেল পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়, সেখানে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি ব্যবহৃত হতে পারে ১ হাজার চার্জ সাইকেল থেকেও কম সংখ্যকবার। অর্থাৎ ১ বা সর্বোচ্চ ২ বছর ঠিকঠাক ব্যবহার করার পরই লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির জীবনচক্রের পরিসমাপ্তি ঘটে।

এ সীমাবদ্ধতা দূর করতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় অবস্থিত ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির ক্যাথোডের উপাদান পরিবর্তন করে ওই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে হঠাৎ এক আবিষ্কারের দেখা পান। নিরীক্ষাকালীন সময়ে ড্রেক্সেল দলের মূল লক্ষ্য ছিল লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির চার্জ এবং ডিসচার্জের সময় পলিসালফাইড তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে ধীরগতির করে দেওয়া। আর এই পলিসালফাইড সৃষ্টির বিষয়টিই লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির সেই সীমাবদ্ধতা। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট পলিসালফাইড আদতে ইলেকট্রোডে থাকা সালফারকে বের করে আনে এবং যার কারণে ব্যাটারির কার্যক্ষমতা ও সর্বোপরি মেয়াদকাল অনেক কমে যায়।

ড্রেক্সেলের গবেষক দলের পলিসালফাইড তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে শ্লথ করার লক্ষ্য থাকলেও তারা বরং অভিনব এক ঘটনার স্বাক্ষী হয়। তারা নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে সালফারের রাসায়নিক এক দশা সৃষ্টির ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে এবং সালফারের যে রাসায়নিক দশা ব্যাটারির ক্ষয় রোধ করতে সক্ষম।

এমন আবিষ্কার ড্রেক্সেল দলকে বিস্মিত করে তোলে এবং অবিশ্বাস্য এই আবিষ্কার যথাযথ কি-না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে তারা শতবারের বেশি পুনর্নিরীক্ষা চালান। আর প্রতিবারই একই ফলাফল আসতে থাকে।  

সালফারের এমন রাসায়নিক অবস্থার নাম মনোক্লিনিক গামা-ফেইজ সালফার। পূর্বে এই অবস্থার দেখা মিলেছিল শুধু একবারই- তা ঘটেছিল পরীক্ষাগারের অতি উচ্চ তাপমাত্রায় (৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রায়)। কিন্তু কক্ষ তাপমাত্রায় সর্বপ্রথম ওই অবস্থার দেখা পাওয়া গেল।   

লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারিতে মনোক্লিনিক গামা-ফেইজ সালফার পলিসালফাইড তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল এবং তা এতটাই কার্যকরী ছিল যে, গবেষক দল পরীক্ষায় ব্যবহৃত ব্যাটারিকে ৪ হাজার চার্জ সাইকেলের ভেতর দিয়ে নেওয়া স্বত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে তা নিজের কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। যার অর্থ হচ্ছে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির তুলনায় যা দ্বিগুণ বেশি সময় কার্যকরী থাকার সামর্থ্য রাখে।

প্রসঙ্গত, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির তুলনায় ওই ব্যাটারির এনার্জি ডেন্স তিন গুণ বেশি ছিল অর্থাৎ যা চার্জ হতে সময় নিয়েছিল লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির মতো একই সময়। 

ড্রেক্সেল দলের এই সাফল্য অর্থাৎ পলিসালফাইডঘটিত জটিলতা যদি লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি বাণিজ্যিকভাবেও উতরে যেতে পারে তাহলে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির পরিবর্তে হালকা, সস্তা, পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর এবং অধিক কার্যকরী লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি আসন্ন সময়ে স্মার্টফোন, বৈদ্যুতিক গাড়ি থেকে শুরু করে ভবিষ্যত বিশ্বের প্রযুক্তি-সামগ্রীর বিকল্প মূল শক্তির উৎস হয়ে উঠতে পারে। 

কঙ্গোর মতো নাজুক একটি দেশের ওপর লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে ব্যবহৃত উচ্চ মূল্যের উপাদান কোবাল্টের সিংহভাগ যোগান (প্রায় ৭০%) নির্ভর করে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ বা এমনকি ২০২৫ সালের দিকে কোবাল্টের সরবরাহ বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হবে। অন্যদিকে, খুবই সস্তা কাঁচামাল, সহজপ্রাপ্যতা ও উপাদান হিসেবে প্রাচুর্যের বিবেচনায় পৃথিবীর দশম স্থান অধিকার করে আছে সালফার।

এছাড়া, স্পেসিফিক এনার্জি বা ইউনিট প্রতি শক্তি বিবেচনায় আনলে দেখা যায় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির মাত্রা যেখানে মাত্র ১৫০-২৬০ ওয়াট ঘণ্টা/কিলোগ্রাম সেখানে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির মাত্রা তা থেকে দ্বিগুণেরও বেশি (প্রায় ৫৫০ ওয়াট ঘণ্টা/কিলোগ্রাম)।

পাশাপাশি বাণিজ্যিক পরিসরে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি তৈরিতে অতিরিক্ত খরচ পাশ কাটানোরও সুযোগ থাকছে। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত কারখানাই লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি উৎপাদনে ব্যবহার করা যাবে। ফলে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির বাণিজ্যিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নতুনভাবে অবকাঠামো তৈরি করতে হবে না বলে সেই সুযোগ তৈরি হতে পারে। 

তাই ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অকস্মাৎ এ আবিষ্কার সারা পৃথিবীর শক্তির ব্যবহারে বিপ্লব নিয়ে আসতে পারে এবং পৃথিবীকে কার্বনমুক্ত, দূষণ কমিয়ে এক নির্মল পরিবেশ উপহার দিতে পারে। সেজন্য এ উদ্ভাবন যেন গবেষণাগার থেকে অতি দ্রুত সফলভাবে বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে পৌঁছায় এবং ব্যবহৃত হতে শুরু করে, সে ব্যাপারে অপেক্ষা করতে হবে।