করাতী সম্প্রদায় বা ঢাওই করাত

#
news image

গোলাম মোস্তফা
প্রাচীন যুগের মানুষ যখন ন্যূনতম সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে পৌছে তখন থেকেই লোহার ব্যবহারের কৌশল জানতে চেষ্টা করে। সেই আধিকাল থেকেই গৃহস্থালির গৃহসজ্জা কাজে লোহার ব্যবহার শিখতে শুরু করে মানুষ। উপনিবেশকাল থেকে হাজার বছর ধরে বিশ^জুড়ে লোহার তৈরি বিভিন্ন ধরনের করাতের প্রচলন শুরু হয়।

কয়েক হাজার বছর আগে মানুষ যখন বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতো তখনই মানুষ গাছ কাটার জন্য খাঁজকাটা করাত ব্যবহার শিখে। মধ্যযুগে মানুষ যখন সভ্যতার দ্বার প্রান্তে এসে পৌছে তখন বনের কাঠ-বাঁশ, ডালপালা, দিয়ে বসবাসের জন্য ঘর বানাতে কাঠ চেরাই কাজে করাতের ব্যবহার শুরু করে। তবে কত সনে কাঠ চেরাই করার জন্য করাত ব্যবহার শুরু হয় তার সঠিক তথ্য পাওয়া যাইনি। চায়নিজ দার্শনিকদের মতে, করাত আবিষ্কার হয়েছে লু বান দ্বারা।

গ্রীক পৌরাণিক কাহীনিতে অভিড বর্ণনা করেছেন টেলস, ডাইডেলাসের ভাগ্নে করাত আবিষ্কার করেন। প্রত্নতত্ত্বের সূত্র অনুযায়ী প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে ধারালো ব্যবহার্য জিনিসপত্রের হাড় দিয়ে প্রথমত করাত সৃষ্টির প্রথম স্তার বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞরা। তবে করাত আবিস্কারের সময়কাল ও ব্যবহারের বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞাদের মত পার্থক্যতা রয়েছে, অনেকে মনে করেন প্রাচীন কালে করাত ছিল মূলত হাঙ্গর মাছের দাঁত, কাঁচের মতো দেখতে অগ্নেয়শিলা, চকমকি পাথরের তৈরি কিছু বস্তÍু। প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসে ৩১০০ খ্রিস্টপূবাব্দে ডিজের রাজার শাসনামলে প্রথম কপারের করাতের সন্ধ্যান পাওয়া যায়। কপারের করাত মূলত খাঁজকাট ধারালো দাঁত যুক্ত।

এরপর বিভিন্ন  রাজা বাদশার শাসনামলে বিভিন্ন ধরনের ভিন্ন-ভিন্ন নামে করাত আবিষ্কার হয়। সেই প্রাচীন যুগে করাত যে ভাবেই তৈরি হউক না কেন পরবর্তি সময় আধুনিক সভ্যতার প্রযুক্তিতে তৈরি করাতগুলো জাপানিজ করাত, বাচারের করাত, বরফ করাত, খনির করাত, গ্রিডার করাত, ফ্রেট করাত, প্যানেল করাত, হাতল করাত, প্লাইউড করাত, প্রুনিং করাত, স্কেলযুক্ত করাত, লবণ করাত, তুর্কি করাত, তারের করাত, ব্লিজ করাত, ইলেক্টিসিয়ান করাত যা ছোট একটি করাত যার ব্যবহার মূলত বিংশ শতাব্দীতে শুরু হয়। এ করাতের উপরের আবরণ তৈরি হয় কাঠ দিয়ে যাতে ভেতরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত না হয়। এছাড়াও ১৪ থেকে ১৫ ইঞ্চি লম্বা ব্লেডযুক্ত সার্শি করাতসহ প্রায় দু‘শতাধিক করাত নানান নামে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। এর প্রায় কয়েক হাজার বছর পর করাতি সম্প্রদায় গড়ে উঠেনি। (তথ্য সংগৃহীত) 

১৯৬৮ সালের দিকে আমাদের দেশে বাওয়ালিদের সুন্দরবনের গাছ ও আসাম থেকে আসা কাঠ চেরাই করার জন্য করাতী সম্প্রদায় গড়ে উঠে। বর্তমানে আধুনিকতার দাপট আর সভ্যতার ক্রমবিকাশের ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢাওই করাতী সম্প্রদায়। বাওয়ালিদের মাছা বাধা কাঠের কাঠামোর তৈরির মেড়ার ঘরকে বলা হত করাতি ঘর। একসময় দোছালা মেড়াঘরেই ঢাওই করাত দিয়ে বড় বড় গাছ চেরাই করা হতো। এ ধরনের ঢাওই করাতিদের করাতী সম্প্রদায় বলে।

লৌহনির্মিত খাঁজকাটা ঢাওই করাত কালের বিবর্তন ও আধুনিকতার ছোয়ায় নিত্য নতুন প্রযুক্তির কাছে টিকতে না পেরে করাতী সম্প্রদায় বা ঢাওই করাত ১৯৮৯ সালের দিকে বিলুপ্ত হতে শুরু হয়। আবার অনেক করাতী সম্প্রদায় শ্রমীমিকরা বাপ-দাদার এ পেশায় আগের মত সুবিধাজনক স্থানে  থাকতে না পেরে জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা এ পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছে অনেক আগেই। তাই আগের মতো তেমন আর চোখে পড়ছে না করাতী সম্প্রদায় বা ঢাওই করাতিদের। একসময় গাছ কাটতে হলে বা গাছ দ্বারা তক্তা-খুটি কিংবা ঘরের অন্যকিছু তৈরি করতে হলে করাতী সম্প্রদায়ের জন্য গৃহস্থালীদের অপেক্ষায় থাকতে হতো।

কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলার সেই করাতী সম্প্রদায় ও ঢাওই করাতের  ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে প্রায় ৬ দশক আগে। লৌহার একটি ঢাওই করাত ২২ থেকে ২৫ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। মাঝখান ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি চ্যাপ্টা লৌহপাত দ্বারা নির্মিত। এ করাতটির দুই মাথা একই লেভেলে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি চ্যাপ্টা রয়েছে। গাছ কাটার জন্য এ ঢাওই করাতের দুই প্রান্তের শেষ মাথার অংশে কাঠের দুইটি হাতল থাকে। করাতের এ হাতল দুইটি মুঠ করে ধরে উপর- নিজ টেনে বড় বড় গাছ চেরাই করা হয়। এ ধরনের করাতকে আঞ্চলিক ভাষায় ঢাওই করাত বা বাওয়ালি করাতও বলা হয়।

কারণ সুন্দরবন থেকে আসা সুন্দরী গাছ ও অঞ্চল ভিত্তিক গাছগুলো করাতী সম্প্রদায়রা ঢাওই করাত (অঞ্চলিক নাম) দ্বারা গাছ চেরাই করে ঘর-বাড়ি নির্মানসহ বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র তৈরি করতো। সুন্দর বন থেকে বাওয়ালিরা সুন্দরী গাছ এনে এ করাত দিয়ে চেরাই করে বিভিন্ন ধরনের তক্ত¦া তৈরি করার ফলে এ করাতকে বাওয়ালি করাতও বলা হতো। এ করাতের বৈশিষ্ট্য হলো তক্ত¦া সদৃশ্য লোহার লম্বা পাত দ্বারা নির্মিত শক্ত ও তীক্ষè খাঁজ কাটা বিশিষ্ট এক ধরনের যন্ত্র বিশেষ যা দিয়ে গাছ কাটা ও চেরাই করা হয়।

ঢাওই করাতের এক পাশ পুরোটাই খাঁজ-কাটা ধারালো দাঁতের মত এবং অপর পাশ মসৃণ। গাছ কাটা বা চেরাই করার জন্য ঢাওই করাত চালাতে চার পাশে চারটি খুঁটির উপর কাঠের কাঠামো দ্বারা ৬ থেকে ৭ ফুট উঁচু এবং ১৩ থেকে ১৪ ফুট লম্বা এক ধরনের মেড়াঘর তৈরি করা হয়। এ ঘরের কাঠামোর মাঝখানে আড়া-আড়িভাবে দুইটি কাঠ বা বাহল দিয়ে তৈরি করা হয় কাঠের মাছা। মাছার বাহল দুইটির উপর গাছ রেখে গাছের উপর একজন করাতি, মাঠিতে দুইজন করাতি, করাতটি উপর- নিজ টেনে গাছ চেরাই করে তক্ত¦া,

খুঁটি বা যে যার মত কাঠের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তৈরি করতো। তবে করাতী সম্প্রদায়ের একটি গাছ চেরাই করতে মেড়াঘরের তিনজন ঢাওই করাতি প্রয়োজন হয়। তিন সদস্য বিশিষ্ট  করাতির একজন মাছায় গাছের উপরে ও দু‘জন মাছার নিছে করাতটি উপর- নিজ টেনে গাছ থেকে তক্তা, খুটি ও বিম সহ বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র তৈরির করে ঘর-বাড়ি, নৌকার তক্ত¦ সহ নানান ধরনের কাঠ তৈরি করা হয়। করাতী সম্প্রদায় মেড়াঘরে ঢাওই করাত দিয়ে গাছ কাটার সেই দৃশ্য নতুন প্রযুক্তি আর যান্ত্রি করাতের প্রভাবে গ্রামবাংলার থেকে হারিয়ে গেছে।

তবে আবার বর্গফুট অনুযায়ী সাইজ করার জন্য যে করাত ব্যবহার করা হয় তাকে খাঁজকাটা হাতলযুক্ত বা রাম করাত বলে। এ করাত চালাতে কাঠের কাঠামো মেড়াঘরের প্রয়োজন হয় না। ১৮ থেকে ২০ ফুট লম্বা হাতলযুক্ত করাত দিয়ে খাড়া গাছ কাটাসহ মাটিতে ফেলে রাখা গাছও কাটা হয়।

এ ধরনের করাত দিয়ে গাছ কাটার বৈশিষ্ট্যতা হলো গাছটি একটু উচুঁ জায়গায় রেখে মাঝখান দিয়ে করাত চালানোর সময় দুই মাথায় দুইজন করাতি করাতের হাতল টানা-টানি করলেই গাছটি দুই ভাগ হয়ে যায়। এ জাতিয় করাতকে হাতলযুক্ত বা রাম করাত বলে। বর্তমানে হাতলযুক্ত করাতের কিছুটা প্রচলন থাকলেও বিলুপ্তি হয়ে গেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বাওয়ালি বা ঢাওই করাত।

আমাদের দেশে একসময় গাছকাটার জন্য ঢাওই করাত গ্রামবাংলার একটি চিরচেনা ঐতিহ্য করাত। এ করাত আধিকালের করাত থেকে ভিন্ন ধরনের একটি করাত যা গ্রাম্য অঞ্চলেই এক সময বেশিভাগ পরিচিতি হয়ে উঠে। এটি বাঙালির গ্রাম্য অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব একটি সংস্কৃতির ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্য আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে ১৯৭০ এরপর ১৯৮৮ সালেও করাতী সম্প্রদায়ের ঢাওই করাতের প্রচলন ছিল এবং তখন এ পেশায় পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাগের হাট, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর  ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় লক্ষ্যদিক মানুষ এ কারাতি কাজে নিয়োজিত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো।

১৯৮৮ সালে শেষ দিকে এরশাদ সরকারের বনবিভাগ মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তর সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ কাটার পারমিট বন্ধ করে দেওয়ায় করাতী সম্প্রদায় বিলুপ্ত হতে শুরু হয়। সুন্দর বন থেকে সুন্দরী গাছ কাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের জেলাগুলোতে ঢাওই করাতী কাজ বন্ধ হয়ে যায় এরপর পর্যায়ক্রমে ১৯৯০সালে করাতী সম্প্রদায় বিলুপ্তি হয়ে যায়। এ বেকার হয়ে পড়ে বাওয়ালি গোষ্ঠী, কাঠামি নৌকার হাজারও মাঝি, শ্রমজীবী করাতী সম্প্রদায় ও দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীসহ প্রায় দু‘লক্ষ্যধিক মানুষ। এসব মানুষ বিভিন্ন পেশায় চলে গেলেও অনেকে চলে গেছেন নিম্ম আয়ের মাটিতোলা কাজে। আধুনিক যুগে আধুনিক পণ্যের কাছে, আধুনিক কলা কৌশলের নিকট শত বছর ধরে চলে আসা বাঙালিদের সংস্কৃতির কিছু ঐতিহ্যবাহী উপদান বিলীন হয়ে গেছে এর মধ্যে মেড়াঘরের ঢাওই করাত একটি।

এই ঢাওই করাত এখন আর দেখা যায় না। আশি দশকের শেষ দিকেও করাতিদের ঢাওই করাতে গাছ কাটার দৃশ্য দেখা যেত। আজ সেই গ্রামবাংলার শত বছরের ্ঐতিহ্য করাতি সম্প্রদায় আর নেই। করাত বাঙালি লোক সংস্কৃতির একটি উপদান। বর্তমানে আধুনিকতার উৎকর্ষেহ পল্লী অঞ্চলের মেড়াঘরের ঢাওই করাতে গাছ কাটার সেই দৃশ্য আমাদের কাছে স্মৃতি স্বরুপ মনে হলেও, নতুন প্রম্মের কাছে শুধুই মাত্র গল্প।

নব্বই দশকের কথা বলছি, সে সময়ও ঢাওই করাত কোনো রকমে ছড়িয়ে-ছিড়িয়ে টিকে থাকলেও গাছ কাটার সমিল ও করাতকলের যান্ত্রিক সুবিধা এবং প্রগতি ও প্রযুক্তির দাপটে ১৯৯২ সালে সম্পূর্ণভাবে করাতী সম্প্রদায় বা মেড়াঘরের ঢাওই করাত বিলুপ্তি হয়ে যায়। সেই মেড়াঘরের ঢাওই করাতের দৃশ্য নতুন প্রম্ম হয়তো আর দেখবে না, শ্রমজীবী করাতি সম্প্রদায় অধিক পরিশ্রমে সীমিত আয়ের টাকা দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে অভাবী ও সংগ্রামী জীবনেও ওদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াও করিয়েছে।

ওরা গরীবের মধ্যে সব চেয়ে বেশি গরিব ছিল। শীতের মৌসুম সকাল- সন্ধ্যা রুটি,গুড়- পান্তা খেয়ে ওদের কাজ, পুরো দিনটাই কঠিন পরিশ্রমের ঢাওই করাতের কাজ করতে হতো। দিন শেষে শ্রম মজুরি পরিশোদ পেতেও সময় লাগতো প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত। একজন করাতির তখন দৈনিক মজুরি ছিল দেড়‘শ থেকে দু‘শত টাকা। এই সীমিত উপার্জনের টাকা দিয়ে সংসারে রুটি-পান্তার যোগান দিয়ে অনেক করাতী সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের উচ্চশিক্ষিতও করেছেন।

হয়তো অনেক করাতীর ছেলে- মেয়ে আজ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার পদে বসে আছেন। তবে তারা কী কখনো মনে রেখেছেন সেই বাবার কথা? এটি একটি উদাহরণ স্বরুপ কথা হলেও বর্তমানে অনেকের সক্ষম সন্তান থাকতেও অনেক পিতা-মাতাকে বৃদ্ধা বয়স পার করতে হচ্ছে বৃদ্ধা আশ্রমে। (করাতী সম্প্রদায় বা ঢাওই করাত শিরনামে দৈনিক “আমাদের বরিশাল” পত্রিকায়-১৪ ডিসেম্বর -৪ পৃষ্ঠিায় প্রকাশিত আমার নিউজ থেকে নেওয়া)

 

নাগরিক ডেস্ক

০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩,  7:23 AM

news image

গোলাম মোস্তফা
প্রাচীন যুগের মানুষ যখন ন্যূনতম সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে পৌছে তখন থেকেই লোহার ব্যবহারের কৌশল জানতে চেষ্টা করে। সেই আধিকাল থেকেই গৃহস্থালির গৃহসজ্জা কাজে লোহার ব্যবহার শিখতে শুরু করে মানুষ। উপনিবেশকাল থেকে হাজার বছর ধরে বিশ^জুড়ে লোহার তৈরি বিভিন্ন ধরনের করাতের প্রচলন শুরু হয়।

কয়েক হাজার বছর আগে মানুষ যখন বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতো তখনই মানুষ গাছ কাটার জন্য খাঁজকাটা করাত ব্যবহার শিখে। মধ্যযুগে মানুষ যখন সভ্যতার দ্বার প্রান্তে এসে পৌছে তখন বনের কাঠ-বাঁশ, ডালপালা, দিয়ে বসবাসের জন্য ঘর বানাতে কাঠ চেরাই কাজে করাতের ব্যবহার শুরু করে। তবে কত সনে কাঠ চেরাই করার জন্য করাত ব্যবহার শুরু হয় তার সঠিক তথ্য পাওয়া যাইনি। চায়নিজ দার্শনিকদের মতে, করাত আবিষ্কার হয়েছে লু বান দ্বারা।

গ্রীক পৌরাণিক কাহীনিতে অভিড বর্ণনা করেছেন টেলস, ডাইডেলাসের ভাগ্নে করাত আবিষ্কার করেন। প্রত্নতত্ত্বের সূত্র অনুযায়ী প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে ধারালো ব্যবহার্য জিনিসপত্রের হাড় দিয়ে প্রথমত করাত সৃষ্টির প্রথম স্তার বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞরা। তবে করাত আবিস্কারের সময়কাল ও ব্যবহারের বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞাদের মত পার্থক্যতা রয়েছে, অনেকে মনে করেন প্রাচীন কালে করাত ছিল মূলত হাঙ্গর মাছের দাঁত, কাঁচের মতো দেখতে অগ্নেয়শিলা, চকমকি পাথরের তৈরি কিছু বস্তÍু। প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসে ৩১০০ খ্রিস্টপূবাব্দে ডিজের রাজার শাসনামলে প্রথম কপারের করাতের সন্ধ্যান পাওয়া যায়। কপারের করাত মূলত খাঁজকাট ধারালো দাঁত যুক্ত।

এরপর বিভিন্ন  রাজা বাদশার শাসনামলে বিভিন্ন ধরনের ভিন্ন-ভিন্ন নামে করাত আবিষ্কার হয়। সেই প্রাচীন যুগে করাত যে ভাবেই তৈরি হউক না কেন পরবর্তি সময় আধুনিক সভ্যতার প্রযুক্তিতে তৈরি করাতগুলো জাপানিজ করাত, বাচারের করাত, বরফ করাত, খনির করাত, গ্রিডার করাত, ফ্রেট করাত, প্যানেল করাত, হাতল করাত, প্লাইউড করাত, প্রুনিং করাত, স্কেলযুক্ত করাত, লবণ করাত, তুর্কি করাত, তারের করাত, ব্লিজ করাত, ইলেক্টিসিয়ান করাত যা ছোট একটি করাত যার ব্যবহার মূলত বিংশ শতাব্দীতে শুরু হয়। এ করাতের উপরের আবরণ তৈরি হয় কাঠ দিয়ে যাতে ভেতরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত না হয়। এছাড়াও ১৪ থেকে ১৫ ইঞ্চি লম্বা ব্লেডযুক্ত সার্শি করাতসহ প্রায় দু‘শতাধিক করাত নানান নামে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। এর প্রায় কয়েক হাজার বছর পর করাতি সম্প্রদায় গড়ে উঠেনি। (তথ্য সংগৃহীত) 

১৯৬৮ সালের দিকে আমাদের দেশে বাওয়ালিদের সুন্দরবনের গাছ ও আসাম থেকে আসা কাঠ চেরাই করার জন্য করাতী সম্প্রদায় গড়ে উঠে। বর্তমানে আধুনিকতার দাপট আর সভ্যতার ক্রমবিকাশের ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢাওই করাতী সম্প্রদায়। বাওয়ালিদের মাছা বাধা কাঠের কাঠামোর তৈরির মেড়ার ঘরকে বলা হত করাতি ঘর। একসময় দোছালা মেড়াঘরেই ঢাওই করাত দিয়ে বড় বড় গাছ চেরাই করা হতো। এ ধরনের ঢাওই করাতিদের করাতী সম্প্রদায় বলে।

লৌহনির্মিত খাঁজকাটা ঢাওই করাত কালের বিবর্তন ও আধুনিকতার ছোয়ায় নিত্য নতুন প্রযুক্তির কাছে টিকতে না পেরে করাতী সম্প্রদায় বা ঢাওই করাত ১৯৮৯ সালের দিকে বিলুপ্ত হতে শুরু হয়। আবার অনেক করাতী সম্প্রদায় শ্রমীমিকরা বাপ-দাদার এ পেশায় আগের মত সুবিধাজনক স্থানে  থাকতে না পেরে জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা এ পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছে অনেক আগেই। তাই আগের মতো তেমন আর চোখে পড়ছে না করাতী সম্প্রদায় বা ঢাওই করাতিদের। একসময় গাছ কাটতে হলে বা গাছ দ্বারা তক্তা-খুটি কিংবা ঘরের অন্যকিছু তৈরি করতে হলে করাতী সম্প্রদায়ের জন্য গৃহস্থালীদের অপেক্ষায় থাকতে হতো।

কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলার সেই করাতী সম্প্রদায় ও ঢাওই করাতের  ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে প্রায় ৬ দশক আগে। লৌহার একটি ঢাওই করাত ২২ থেকে ২৫ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। মাঝখান ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি চ্যাপ্টা লৌহপাত দ্বারা নির্মিত। এ করাতটির দুই মাথা একই লেভেলে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি চ্যাপ্টা রয়েছে। গাছ কাটার জন্য এ ঢাওই করাতের দুই প্রান্তের শেষ মাথার অংশে কাঠের দুইটি হাতল থাকে। করাতের এ হাতল দুইটি মুঠ করে ধরে উপর- নিজ টেনে বড় বড় গাছ চেরাই করা হয়। এ ধরনের করাতকে আঞ্চলিক ভাষায় ঢাওই করাত বা বাওয়ালি করাতও বলা হয়।

কারণ সুন্দরবন থেকে আসা সুন্দরী গাছ ও অঞ্চল ভিত্তিক গাছগুলো করাতী সম্প্রদায়রা ঢাওই করাত (অঞ্চলিক নাম) দ্বারা গাছ চেরাই করে ঘর-বাড়ি নির্মানসহ বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র তৈরি করতো। সুন্দর বন থেকে বাওয়ালিরা সুন্দরী গাছ এনে এ করাত দিয়ে চেরাই করে বিভিন্ন ধরনের তক্ত¦া তৈরি করার ফলে এ করাতকে বাওয়ালি করাতও বলা হতো। এ করাতের বৈশিষ্ট্য হলো তক্ত¦া সদৃশ্য লোহার লম্বা পাত দ্বারা নির্মিত শক্ত ও তীক্ষè খাঁজ কাটা বিশিষ্ট এক ধরনের যন্ত্র বিশেষ যা দিয়ে গাছ কাটা ও চেরাই করা হয়।

ঢাওই করাতের এক পাশ পুরোটাই খাঁজ-কাটা ধারালো দাঁতের মত এবং অপর পাশ মসৃণ। গাছ কাটা বা চেরাই করার জন্য ঢাওই করাত চালাতে চার পাশে চারটি খুঁটির উপর কাঠের কাঠামো দ্বারা ৬ থেকে ৭ ফুট উঁচু এবং ১৩ থেকে ১৪ ফুট লম্বা এক ধরনের মেড়াঘর তৈরি করা হয়। এ ঘরের কাঠামোর মাঝখানে আড়া-আড়িভাবে দুইটি কাঠ বা বাহল দিয়ে তৈরি করা হয় কাঠের মাছা। মাছার বাহল দুইটির উপর গাছ রেখে গাছের উপর একজন করাতি, মাঠিতে দুইজন করাতি, করাতটি উপর- নিজ টেনে গাছ চেরাই করে তক্ত¦া,

খুঁটি বা যে যার মত কাঠের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তৈরি করতো। তবে করাতী সম্প্রদায়ের একটি গাছ চেরাই করতে মেড়াঘরের তিনজন ঢাওই করাতি প্রয়োজন হয়। তিন সদস্য বিশিষ্ট  করাতির একজন মাছায় গাছের উপরে ও দু‘জন মাছার নিছে করাতটি উপর- নিজ টেনে গাছ থেকে তক্তা, খুটি ও বিম সহ বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র তৈরির করে ঘর-বাড়ি, নৌকার তক্ত¦ সহ নানান ধরনের কাঠ তৈরি করা হয়। করাতী সম্প্রদায় মেড়াঘরে ঢাওই করাত দিয়ে গাছ কাটার সেই দৃশ্য নতুন প্রযুক্তি আর যান্ত্রি করাতের প্রভাবে গ্রামবাংলার থেকে হারিয়ে গেছে।

তবে আবার বর্গফুট অনুযায়ী সাইজ করার জন্য যে করাত ব্যবহার করা হয় তাকে খাঁজকাটা হাতলযুক্ত বা রাম করাত বলে। এ করাত চালাতে কাঠের কাঠামো মেড়াঘরের প্রয়োজন হয় না। ১৮ থেকে ২০ ফুট লম্বা হাতলযুক্ত করাত দিয়ে খাড়া গাছ কাটাসহ মাটিতে ফেলে রাখা গাছও কাটা হয়।

এ ধরনের করাত দিয়ে গাছ কাটার বৈশিষ্ট্যতা হলো গাছটি একটু উচুঁ জায়গায় রেখে মাঝখান দিয়ে করাত চালানোর সময় দুই মাথায় দুইজন করাতি করাতের হাতল টানা-টানি করলেই গাছটি দুই ভাগ হয়ে যায়। এ জাতিয় করাতকে হাতলযুক্ত বা রাম করাত বলে। বর্তমানে হাতলযুক্ত করাতের কিছুটা প্রচলন থাকলেও বিলুপ্তি হয়ে গেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বাওয়ালি বা ঢাওই করাত।

আমাদের দেশে একসময় গাছকাটার জন্য ঢাওই করাত গ্রামবাংলার একটি চিরচেনা ঐতিহ্য করাত। এ করাত আধিকালের করাত থেকে ভিন্ন ধরনের একটি করাত যা গ্রাম্য অঞ্চলেই এক সময বেশিভাগ পরিচিতি হয়ে উঠে। এটি বাঙালির গ্রাম্য অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব একটি সংস্কৃতির ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্য আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে ১৯৭০ এরপর ১৯৮৮ সালেও করাতী সম্প্রদায়ের ঢাওই করাতের প্রচলন ছিল এবং তখন এ পেশায় পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাগের হাট, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর  ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় লক্ষ্যদিক মানুষ এ কারাতি কাজে নিয়োজিত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো।

১৯৮৮ সালে শেষ দিকে এরশাদ সরকারের বনবিভাগ মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তর সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ কাটার পারমিট বন্ধ করে দেওয়ায় করাতী সম্প্রদায় বিলুপ্ত হতে শুরু হয়। সুন্দর বন থেকে সুন্দরী গাছ কাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের জেলাগুলোতে ঢাওই করাতী কাজ বন্ধ হয়ে যায় এরপর পর্যায়ক্রমে ১৯৯০সালে করাতী সম্প্রদায় বিলুপ্তি হয়ে যায়। এ বেকার হয়ে পড়ে বাওয়ালি গোষ্ঠী, কাঠামি নৌকার হাজারও মাঝি, শ্রমজীবী করাতী সম্প্রদায় ও দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীসহ প্রায় দু‘লক্ষ্যধিক মানুষ। এসব মানুষ বিভিন্ন পেশায় চলে গেলেও অনেকে চলে গেছেন নিম্ম আয়ের মাটিতোলা কাজে। আধুনিক যুগে আধুনিক পণ্যের কাছে, আধুনিক কলা কৌশলের নিকট শত বছর ধরে চলে আসা বাঙালিদের সংস্কৃতির কিছু ঐতিহ্যবাহী উপদান বিলীন হয়ে গেছে এর মধ্যে মেড়াঘরের ঢাওই করাত একটি।

এই ঢাওই করাত এখন আর দেখা যায় না। আশি দশকের শেষ দিকেও করাতিদের ঢাওই করাতে গাছ কাটার দৃশ্য দেখা যেত। আজ সেই গ্রামবাংলার শত বছরের ্ঐতিহ্য করাতি সম্প্রদায় আর নেই। করাত বাঙালি লোক সংস্কৃতির একটি উপদান। বর্তমানে আধুনিকতার উৎকর্ষেহ পল্লী অঞ্চলের মেড়াঘরের ঢাওই করাতে গাছ কাটার সেই দৃশ্য আমাদের কাছে স্মৃতি স্বরুপ মনে হলেও, নতুন প্রম্মের কাছে শুধুই মাত্র গল্প।

নব্বই দশকের কথা বলছি, সে সময়ও ঢাওই করাত কোনো রকমে ছড়িয়ে-ছিড়িয়ে টিকে থাকলেও গাছ কাটার সমিল ও করাতকলের যান্ত্রিক সুবিধা এবং প্রগতি ও প্রযুক্তির দাপটে ১৯৯২ সালে সম্পূর্ণভাবে করাতী সম্প্রদায় বা মেড়াঘরের ঢাওই করাত বিলুপ্তি হয়ে যায়। সেই মেড়াঘরের ঢাওই করাতের দৃশ্য নতুন প্রম্ম হয়তো আর দেখবে না, শ্রমজীবী করাতি সম্প্রদায় অধিক পরিশ্রমে সীমিত আয়ের টাকা দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে অভাবী ও সংগ্রামী জীবনেও ওদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াও করিয়েছে।

ওরা গরীবের মধ্যে সব চেয়ে বেশি গরিব ছিল। শীতের মৌসুম সকাল- সন্ধ্যা রুটি,গুড়- পান্তা খেয়ে ওদের কাজ, পুরো দিনটাই কঠিন পরিশ্রমের ঢাওই করাতের কাজ করতে হতো। দিন শেষে শ্রম মজুরি পরিশোদ পেতেও সময় লাগতো প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত। একজন করাতির তখন দৈনিক মজুরি ছিল দেড়‘শ থেকে দু‘শত টাকা। এই সীমিত উপার্জনের টাকা দিয়ে সংসারে রুটি-পান্তার যোগান দিয়ে অনেক করাতী সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের উচ্চশিক্ষিতও করেছেন।

হয়তো অনেক করাতীর ছেলে- মেয়ে আজ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার পদে বসে আছেন। তবে তারা কী কখনো মনে রেখেছেন সেই বাবার কথা? এটি একটি উদাহরণ স্বরুপ কথা হলেও বর্তমানে অনেকের সক্ষম সন্তান থাকতেও অনেক পিতা-মাতাকে বৃদ্ধা বয়স পার করতে হচ্ছে বৃদ্ধা আশ্রমে। (করাতী সম্প্রদায় বা ঢাওই করাত শিরনামে দৈনিক “আমাদের বরিশাল” পত্রিকায়-১৪ ডিসেম্বর -৪ পৃষ্ঠিায় প্রকাশিত আমার নিউজ থেকে নেওয়া)