দেশে ডায়াবেটিস ঝুঁকিতে ৫ শতাংশই শিশু: আক্রান্ত ৫০ ভাগেরই লক্ষণ নেই
এসএম শামসুজ্জোহা
২০ অক্টোবর, ২০২২, 12:18 AM
দেশে ডায়াবেটিস ঝুঁকিতে ৫ শতাংশই শিশু: আক্রান্ত ৫০ ভাগেরই লক্ষণ নেই
ঢাকা, ১৯ অক্টোবর ২২ইং: বাংলাদেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যাও। দেশে ১ কোটির বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে ৫ শতাংশই শিশু। এই হার প্রতিনিয়ত আরও বাড়ছে বলে দাবি করেছেন ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় নিয়োজিত একাধিক বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে, অতিরিক্ত নগরায়ন, জীবনযাপন ও খাদ্যাভাসে পরিবর্তন, কায়িক পরিশ্রমের অভাব এবং অতিমাত্রায় মোবাইলে আসক্তির কারণে শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এটি কমাতে বাচ্চাদের খেলাধুলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, দৌড়ঝাঁপ ছাড়াও দাঁত ও মুখের যত্ন নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এমনকি রোগটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সময়মতো চিকিৎসা নিতেও বলছেন চিকিৎসকরা।
এ ব্যাপারে ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের অধ্যাপক ফারুক পাঠান বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে শিশুদের ডায়াবেটিস বেশি দেখা যাচ্ছে। করোনার মধ্যে এই হার আরও বেড়েছে। আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, আগের চেয়ে শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।’ শিশুদের ডায়াবেটিসের সঠিক পরিসংখ্যান জানতে অনলাইন নিবন্ধনের মতো একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তারা ডাক্তারের কাছে আসেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পাঁচ-ছয় বছর পর। এ দেশের মানুষের আয়ুষ্কাল ৭৩ বছর হলেও ডায়াবেটিস রোগীর আয়ুষ্কাল ৬৩ বছর। শুধু ডায়াবেটিস থাকার কারণেই জীবন থেকে তাদের ১০ বছর ‘নেই’ হয়ে যায়। এই ১০ বছর তারা পরিবার, সমাজ ও দেশকে দিতে পারতেন।’
চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার কামরুল হুদা বলেন, আমাদের হিসাবে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু ১০ হাজার ৮১৭ জন তালিকায় ছিল। আর চলতি বছরের এ পর্যন্ত তালিকা প্রায় ৭ হাজার নাম আছে। প্রতিবছর শূন্য থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত ( শিশু, কিশোর, তরুণ) নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ৪০০-৫০০ জন। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে মোট ১৮ হাজার শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এরমধ্যে ৮২ শতাংশ টাইপ-১ এবং ১৮ শতাংশ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
কামরুল হুদা বলেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত দরিদ্র পরিবারের শিশু রোগীদের আমরা বিনামূল্য চিকিৎসা দিই। আমাদের এ প্রতিষ্ঠানে একটা প্রকল্পের মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া হচ্ছে। মোট রোগীর প্রায় ৬৬ শতাংশ শিশু রোগীর সকল চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হয়। আর পারিবারিকভাবে স্বচ্ছল পারিবারের ৮ শতাংশ শিশু রোগী সম্পূর্ণ নিজস্ব খরচে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকিরা ২৬ শতাংশ শিশু রোগী বিভিন্ন হারে কম মূল্য পরিশোধ করে চিকিৎসা নিচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোটদের যে ডায়াবেটিস হয়, তা বড়দের থেকে ভিন্ন। শিশুদের হয় টাইপ-১ ডায়াবেটিস। আর বড়দের হয় টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে শিশুদের শরীরে রক্তকে নিয়ন্ত্রণ করে ‘ইনসুলিন’ নামক যে হরমোন, সেটা তৈরি হয় না। তাই ইনসুলিন ছাড়া এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, শিশুদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসও বাড়ছে। টাইপ-২ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শিশুদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস কেন হচ্ছে, এর সঠিক কোনো কারণ এখন পর্যন্ত নির্ণয় হয়নি।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো ক্ষেত্রে এটির জন্য জিনকে দায়ী করা হয়, আবার কিছু ক্ষেত্রে পরিবেশগত কারণ ও ভাইরাসের সংক্রমণকেও দায়ী করা হয়। এছাড়া শিশুর জন্মের পর প্রথম তিন মাস বুকের দুধের পরিবর্তে গরুর দুধ খাওয়ালে শিশুর টাইপ-১ ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা আছে। যদি দ্রুত শিশুর টাইপ-১ ডায়াবেটিস শনাক্ত করা যায়, তাহলে শিশুর শ্বাসকষ্ট শুরু হবে এবং মৃত্যুও হতে পারে। অথচ শুধু ইনসুলিন শুরু করলেই সেই ভয়াবহ বিপদ থেকে শিশুকে রক্ষা করা যায়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের বারবার প্রসাব লাগা, ওজন কমে যাওয়া, পিপাসা পাওয়া, খিদে পাওয়া, দুর্বল বোধ করা, কোনো কাজে মন না বসা। এই ছয়টি লক্ষণ থাকলে প্রাথমিকভাবে বোঝা যায় শিশুর ডায়াবেটিস হয়েছে। তখনই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সবার আগে জীবনযাপনের ধরণ পরিবর্তন করতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম বাড়াতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা যায়। এজন্য সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
বাডাসের চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন প্রোগ্রামের কো-অর্ডিনেটর ডা. বেদৌরা জাবীন এ প্রতিবেদককে বলেন, টাইপ-১ ডায়াবেটিস আক্রান্ত বাচ্চার এক দিনও ইনসুলিন ছাড়া সুস্থ থাকা সম্ভব না। কিন্তু বেশিরভাগ শিশু স্বল্প আয়ের পরিবার থেকে আসছে। যাদের পক্ষে এই শিশুদের ব্যয়ভার বহন করা কঠিন। তাদের জীবনে শুধু ইনসুলিন নয়, এর পাশাপাশি প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। দিনে তিন থেকে চারবার ইনসুলিন নিতে হয়, তিন থেকে চার বার রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করাতে হয়, এটা ব্যয়বহুল। এর পাশাপাশি চার থেকে পাঁচবার পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারও তাদের দিতে হয়। তাই আমরা বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। আমরা ইনসুলিনসহ বিভিন্ন ওষুধ শিশুদের বিনামূল্যে দিচ্ছি।
ডা. বেদৌরা জাবীন বলেন, টাইপ-১ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এর প্রভাব ১০-১৫ বছর পড়ে দেখা দিতে পারে। এ রোগের কারণে মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে হার্টঅ্যাটাক, কিডনি ফেইলিউর, অন্ধ হয়ে যাওয়া মতো ঘটনা ঘটতে পারে। তাই চিকিৎকের পরামর্শে নিয়মিত ইনসুলিন নেওয়ার পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, নিয়মিত খেলাধুলা করার পরামর্শ দেন তিনি।
ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ডা. এ কে আজাদ খান প্রভাতী খবরকে বলেন, ‘দেশে ১ কোটি ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী। এর মধ্যে ৫ শতাংশ শিশু জুভেনাইল বা টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। শিশুদের শরীরে ইনসুলিনের অভাবে এই রোগ দেখা দেয়। ইনসুলিন ছাড়া এসব শিশু বাঁচে না। তবে আক্রান্ত এসব শিশুর বেশির ভাগই সচেতনতার অভাবে ইনসুলিন পাচ্ছে না। আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণেও অনেক মা-বাবা তাদের সন্তানদের ইনসুলিন দিতে পারছেন না। তবে তাদের জন্য বিনা মূল্যে ইনসুলিন দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।’
অপ্রতুল চিকিৎসক, ব্যাহত স্বাস্থ্যসেবা: দেশে ১ কোটির বেশি ডায়াবেটিস রোগী থাকলেও তাদের চিকিৎসায় মাত্র ১৫০ জন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট (ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ) রয়েছেন। এ হিসাবে প্রতি ৬৬ হাজার রোগীর সেবায় চিকিৎসক মাত্র একজন। আর মোট জনসংখ্যার হিসাবে প্রতি ১২ লাখ মানুষের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।
গ্রামেও ডায়াবেটিসের উদ্বেগ: ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের প্রধান ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ বলেন, ‘গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা পরিবর্তন হয়েছে। শহরের মানুষের সঙ্গে তাদের মাঝেও কায়িক পরিশ্রমের হার প্রতিনিয়ত কমছে। আগে প্যাডেলের মাধ্যমে রিকশা-ভ্যান চললেও সেগুলোও এখন অটো হয়েছে। এতে উদ্বেগজনক হারে গ্রামেও সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে।’
২০১৮ সালে দেশের সব উপজেলায় ডায়াবেটিস নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানে দেখা যায়, শহর ও গ্রামের মানুষের মাঝে আক্রান্তের পার্থক্য খুব বেশি নয়। শিক্ষিত কিংবা অল্প শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও বড় পার্থক্য দেখা যায়নি। যাদের মধ্যে ধূমপান ও অস্বাভাবিক জীবনযাপন ও শারীরিক পরিশ্রমের হার কম তাদের মাঝে ডায়াবেটিসে ভোগার হার অন্যদের থেকে কিছুটা বেশি।
সরকারের প্রস্তুতি: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (এনসিডিসি) জানিয়েছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৫০ ভাগেরই কোনো লক্ষণ থাকে না। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে চল্লিশোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর ডায়াবেটিস পরীক্ষার জন্য দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থা রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বর্তমানে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে ডায়াবেটিস মাপার যন্ত্র আছে।
ডায়াবেটিসসহ সব অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনসিডিসি কর্নার স্থাপনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সারাদেশে ১০০টি হাসপাতালে চালু হয়েছে। এছাড়া ৮টি মেডিক্যাল কলেজে এন্ডোক্রানোলজি বিভাগ তৈরি হয়েছে। তবে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের পাশাপাশি সবার জন্য সেবা নিশ্চিত করতে পারলে এটি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য দেশের তৃণমূল পর্যায়ে সেবা পৌঁছানোর কথা বলছেন তারা। একই সঙ্গে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ডিজিটাল ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।
এসএম শামসুজ্জোহা
২০ অক্টোবর, ২০২২, 12:18 AM
ঢাকা, ১৯ অক্টোবর ২২ইং: বাংলাদেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যাও। দেশে ১ কোটির বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে ৫ শতাংশই শিশু। এই হার প্রতিনিয়ত আরও বাড়ছে বলে দাবি করেছেন ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় নিয়োজিত একাধিক বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে, অতিরিক্ত নগরায়ন, জীবনযাপন ও খাদ্যাভাসে পরিবর্তন, কায়িক পরিশ্রমের অভাব এবং অতিমাত্রায় মোবাইলে আসক্তির কারণে শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এটি কমাতে বাচ্চাদের খেলাধুলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, দৌড়ঝাঁপ ছাড়াও দাঁত ও মুখের যত্ন নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এমনকি রোগটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সময়মতো চিকিৎসা নিতেও বলছেন চিকিৎসকরা।
এ ব্যাপারে ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের অধ্যাপক ফারুক পাঠান বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে শিশুদের ডায়াবেটিস বেশি দেখা যাচ্ছে। করোনার মধ্যে এই হার আরও বেড়েছে। আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, আগের চেয়ে শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।’ শিশুদের ডায়াবেটিসের সঠিক পরিসংখ্যান জানতে অনলাইন নিবন্ধনের মতো একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তারা ডাক্তারের কাছে আসেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পাঁচ-ছয় বছর পর। এ দেশের মানুষের আয়ুষ্কাল ৭৩ বছর হলেও ডায়াবেটিস রোগীর আয়ুষ্কাল ৬৩ বছর। শুধু ডায়াবেটিস থাকার কারণেই জীবন থেকে তাদের ১০ বছর ‘নেই’ হয়ে যায়। এই ১০ বছর তারা পরিবার, সমাজ ও দেশকে দিতে পারতেন।’
চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার কামরুল হুদা বলেন, আমাদের হিসাবে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু ১০ হাজার ৮১৭ জন তালিকায় ছিল। আর চলতি বছরের এ পর্যন্ত তালিকা প্রায় ৭ হাজার নাম আছে। প্রতিবছর শূন্য থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত ( শিশু, কিশোর, তরুণ) নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ৪০০-৫০০ জন। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে মোট ১৮ হাজার শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এরমধ্যে ৮২ শতাংশ টাইপ-১ এবং ১৮ শতাংশ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
কামরুল হুদা বলেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত দরিদ্র পরিবারের শিশু রোগীদের আমরা বিনামূল্য চিকিৎসা দিই। আমাদের এ প্রতিষ্ঠানে একটা প্রকল্পের মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া হচ্ছে। মোট রোগীর প্রায় ৬৬ শতাংশ শিশু রোগীর সকল চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হয়। আর পারিবারিকভাবে স্বচ্ছল পারিবারের ৮ শতাংশ শিশু রোগী সম্পূর্ণ নিজস্ব খরচে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকিরা ২৬ শতাংশ শিশু রোগী বিভিন্ন হারে কম মূল্য পরিশোধ করে চিকিৎসা নিচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোটদের যে ডায়াবেটিস হয়, তা বড়দের থেকে ভিন্ন। শিশুদের হয় টাইপ-১ ডায়াবেটিস। আর বড়দের হয় টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে শিশুদের শরীরে রক্তকে নিয়ন্ত্রণ করে ‘ইনসুলিন’ নামক যে হরমোন, সেটা তৈরি হয় না। তাই ইনসুলিন ছাড়া এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, শিশুদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসও বাড়ছে। টাইপ-২ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শিশুদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস কেন হচ্ছে, এর সঠিক কোনো কারণ এখন পর্যন্ত নির্ণয় হয়নি।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো ক্ষেত্রে এটির জন্য জিনকে দায়ী করা হয়, আবার কিছু ক্ষেত্রে পরিবেশগত কারণ ও ভাইরাসের সংক্রমণকেও দায়ী করা হয়। এছাড়া শিশুর জন্মের পর প্রথম তিন মাস বুকের দুধের পরিবর্তে গরুর দুধ খাওয়ালে শিশুর টাইপ-১ ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা আছে। যদি দ্রুত শিশুর টাইপ-১ ডায়াবেটিস শনাক্ত করা যায়, তাহলে শিশুর শ্বাসকষ্ট শুরু হবে এবং মৃত্যুও হতে পারে। অথচ শুধু ইনসুলিন শুরু করলেই সেই ভয়াবহ বিপদ থেকে শিশুকে রক্ষা করা যায়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের বারবার প্রসাব লাগা, ওজন কমে যাওয়া, পিপাসা পাওয়া, খিদে পাওয়া, দুর্বল বোধ করা, কোনো কাজে মন না বসা। এই ছয়টি লক্ষণ থাকলে প্রাথমিকভাবে বোঝা যায় শিশুর ডায়াবেটিস হয়েছে। তখনই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সবার আগে জীবনযাপনের ধরণ পরিবর্তন করতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম বাড়াতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা যায়। এজন্য সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
বাডাসের চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন প্রোগ্রামের কো-অর্ডিনেটর ডা. বেদৌরা জাবীন এ প্রতিবেদককে বলেন, টাইপ-১ ডায়াবেটিস আক্রান্ত বাচ্চার এক দিনও ইনসুলিন ছাড়া সুস্থ থাকা সম্ভব না। কিন্তু বেশিরভাগ শিশু স্বল্প আয়ের পরিবার থেকে আসছে। যাদের পক্ষে এই শিশুদের ব্যয়ভার বহন করা কঠিন। তাদের জীবনে শুধু ইনসুলিন নয়, এর পাশাপাশি প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। দিনে তিন থেকে চারবার ইনসুলিন নিতে হয়, তিন থেকে চার বার রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করাতে হয়, এটা ব্যয়বহুল। এর পাশাপাশি চার থেকে পাঁচবার পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারও তাদের দিতে হয়। তাই আমরা বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। আমরা ইনসুলিনসহ বিভিন্ন ওষুধ শিশুদের বিনামূল্যে দিচ্ছি।
ডা. বেদৌরা জাবীন বলেন, টাইপ-১ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এর প্রভাব ১০-১৫ বছর পড়ে দেখা দিতে পারে। এ রোগের কারণে মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে হার্টঅ্যাটাক, কিডনি ফেইলিউর, অন্ধ হয়ে যাওয়া মতো ঘটনা ঘটতে পারে। তাই চিকিৎকের পরামর্শে নিয়মিত ইনসুলিন নেওয়ার পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, নিয়মিত খেলাধুলা করার পরামর্শ দেন তিনি।
ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ডা. এ কে আজাদ খান প্রভাতী খবরকে বলেন, ‘দেশে ১ কোটি ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী। এর মধ্যে ৫ শতাংশ শিশু জুভেনাইল বা টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। শিশুদের শরীরে ইনসুলিনের অভাবে এই রোগ দেখা দেয়। ইনসুলিন ছাড়া এসব শিশু বাঁচে না। তবে আক্রান্ত এসব শিশুর বেশির ভাগই সচেতনতার অভাবে ইনসুলিন পাচ্ছে না। আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণেও অনেক মা-বাবা তাদের সন্তানদের ইনসুলিন দিতে পারছেন না। তবে তাদের জন্য বিনা মূল্যে ইনসুলিন দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।’
অপ্রতুল চিকিৎসক, ব্যাহত স্বাস্থ্যসেবা: দেশে ১ কোটির বেশি ডায়াবেটিস রোগী থাকলেও তাদের চিকিৎসায় মাত্র ১৫০ জন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট (ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ) রয়েছেন। এ হিসাবে প্রতি ৬৬ হাজার রোগীর সেবায় চিকিৎসক মাত্র একজন। আর মোট জনসংখ্যার হিসাবে প্রতি ১২ লাখ মানুষের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।
গ্রামেও ডায়াবেটিসের উদ্বেগ: ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের প্রধান ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ বলেন, ‘গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা পরিবর্তন হয়েছে। শহরের মানুষের সঙ্গে তাদের মাঝেও কায়িক পরিশ্রমের হার প্রতিনিয়ত কমছে। আগে প্যাডেলের মাধ্যমে রিকশা-ভ্যান চললেও সেগুলোও এখন অটো হয়েছে। এতে উদ্বেগজনক হারে গ্রামেও সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে।’
২০১৮ সালে দেশের সব উপজেলায় ডায়াবেটিস নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানে দেখা যায়, শহর ও গ্রামের মানুষের মাঝে আক্রান্তের পার্থক্য খুব বেশি নয়। শিক্ষিত কিংবা অল্প শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও বড় পার্থক্য দেখা যায়নি। যাদের মধ্যে ধূমপান ও অস্বাভাবিক জীবনযাপন ও শারীরিক পরিশ্রমের হার কম তাদের মাঝে ডায়াবেটিসে ভোগার হার অন্যদের থেকে কিছুটা বেশি।
সরকারের প্রস্তুতি: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (এনসিডিসি) জানিয়েছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৫০ ভাগেরই কোনো লক্ষণ থাকে না। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে চল্লিশোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর ডায়াবেটিস পরীক্ষার জন্য দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থা রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বর্তমানে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে ডায়াবেটিস মাপার যন্ত্র আছে।
ডায়াবেটিসসহ সব অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনসিডিসি কর্নার স্থাপনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সারাদেশে ১০০টি হাসপাতালে চালু হয়েছে। এছাড়া ৮টি মেডিক্যাল কলেজে এন্ডোক্রানোলজি বিভাগ তৈরি হয়েছে। তবে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের পাশাপাশি সবার জন্য সেবা নিশ্চিত করতে পারলে এটি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য দেশের তৃণমূল পর্যায়ে সেবা পৌঁছানোর কথা বলছেন তারা। একই সঙ্গে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ডিজিটাল ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।