৫০ শতাংশের বেশিই জানেন না তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৮ মে, ২০২২, 10:52 PM
৫০ শতাংশের বেশিই জানেন না তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে
উচ্চ রক্তচাপ একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা। উচ্চ রক্তচাপ থাকা ৫০ শতাংশের বেশিই জানেন না তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
বিশ্বে প্রতিবছর এক কোটিরও বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপের কারণে মারা যায়, যা সকল সংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি। বাংলাদেশে প্রতি ৫ জনে ১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। উচ্চ রক্তচাপের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। দেশে এ বিষয়ে গণসচেতনতা এবং চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, অতিরিক্ত লবণ বন্ধ করতে পারলে ৫০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যেতো। একজন মানুষের প্রতিদিন ৫ গ্রাম লবণ প্রয়োজন অর্থাৎ এক চামচ। কিন্তু তার বেশি তারা খাচ্ছেন। জেনে খাচ্ছেন আবার না জেনেও খাচ্ছেন। ঘরে তিনি জেনে খাচ্ছেন। আর ঘরের বাইরে যে খাবার খাচ্ছেন, তাতে কি পরিমাণ লবণ আছে, তা না জেনেই খাচ্ছেন। যেমন চিপসে ১০ গ্রাম লবণ থাকে। তা অনেকেই জানেন না। মানুষ শিঙ্গাড়া, ছমুচা বা হোটেল- রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন খাবার খাচ্ছেন, তাতে কী পরিমাণ লবণ রয়েছে তা তিনি না জেনেই খাচ্ছেন। ফলে শরীরে ঢুকছে মাত্রাতিরিক্ত লবণ। ঘরে লবণ খাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পরিবারের সদস্য হিসেবে তরকারিতে ঠিক ক’চামচ লবণ দেয়া দরকার, তার বেশি নয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি, যা ২০৩০ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে ৩ কোটি ৮০ লাখ। তাই বিশেষজ্ঞরা স্কিনিংয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন।
হাসপাতালটির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম জুবায়ের এ প্রসঙ্গে বলেন, ১৮ বছর বয়সে ব্লাড পেশার মাপবেন। যদি দেখেন নরমাল। ছয় মাস এক বছরের মধ্যে মাপতে হবে না। এক বছর পরে আবার মাপবেন।
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, প্রথমে স্কিনিং করতে হবে। স্কিনিংয়ে আসার পর যাদের আছে। তাদের সেই হিসেবে ট্রিটমেন্ট দেয়া। আর যাদের নেই তাদের যাতে না হয় সে হিসেবে কি কি লাইফস্টাইল চেঞ্জ করতে হবে সে বিষয়ে আমরা বলবো। প্রথম কাজ হচ্ছে সবাইকে স্কিনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, অধিকাংশ সময় উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ এবং উপসর্গ থাকে না অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপে ভোগা অনেক রোগী জানেনই না যে, তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এ জন্য উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সকালের দিকে মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, হৃৎপিণ্ডের অনিয়মিত ছন্দ, দৃষ্টিতে পরিবর্তন এবং কানে গুঞ্জন অনুভূত প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অত্যধিক উচ্চ রক্তচাপ ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, বমি, বিভ্রান্তি, উদ্বেগ, বুকে ব্যথা এবং পেশী কম্পনের কারণ হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করার একমাত্র উপায় হলো চিকিৎসক বা পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা রক্তচাপ পরিমাপ করা। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা না হলে, এটি ধমনি এবং মানবদেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এমনকি ধমনি শক্ত হয়ে হৃৎপিণ্ডে রক্ত ও অক্সিজেনের প্রবাহ হ্রাস পেতে পারে। ফলে বুকে ব্যথা বা অ্যানজাইনা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইল এবং হার্ট বিট অনিয়মিত হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ অর্থাৎ স্ট্রোক হতে পারে। এ ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি বিকলও হয়ে যেতে পারে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন, খাদ্যের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ (সোডিয়াম) গ্রহণ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার, তামাক ও অ্যালকোহল সেবন উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে যেমন, শারীরিকভাবে কর্মঠ না থাকা, অতিরিক্ত ওজন, মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি না খাওয়া। এ ছাড়াও পারিবারিকভাবে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস থাকলে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে (৬৫ বছরের পরে) এবং ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ‘বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে, ২০১৮’ অনুযায়ী ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ২১ শতাংশ (নারী ২৪.১ শতাংশ, পুরুষ ১৭.৯ শতাংশ) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত এবং এদের মধ্যে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে মাত্র ১৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে একজনেরও কম। অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮’ অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৭-১৮ সাল সময়ের মধ্যে, ৩৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশে এবং নারীর ক্ষেত্রে এই হার ৩২ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রয়েছে এমন নারী এবং পুরুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার যথাক্রমে ৪৯ শতাংশ এবং ৪২ শতাংশ, যেখানে স্বাভাবিক ওজনের নারী এবং পুরুষের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ২৫ শতাংশ এবং ২৪ শতাংশ। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অর্ধেক নারী (৫১ শতাংশ) এবং দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষই (৬৭ শতাংশ) জানে না যে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই (৬৪ শতাংশ) কোনো ওষুধ সেবন করে না। আরেকটি গবেষণায় ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ। বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মারা যায়, যার অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। ডব্লিউএইচও’র তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ লক্ষাধিক মানুষ অসংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করেন, যার প্রায় অর্ধেক হৃদরোগজনিত।
উচ্চ রক্তচাপ কী ও এর লক্ষণ : রক্তচাপ যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেড়ে যায় তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের রক্তচাপের পরিমাপ ১২০/৮০ মি.মি. পারদচাপ ধরা হয়ে থাকে। রক্তচাপের এই মাত্রা দুইটি ভিন্ন দিনে ১৪০/৯০ মি.মি. পারদচাপ বা তার বেশি হলে বুঝতে হবে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। তবে বয়স নির্বিশেষে রক্তচাপ কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে। ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে ১৩০/৮০ মি.মি. পারদচাপ-এর অধিক হলে তা উচ্চ রক্তচাপের পর্যায়ে পড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে ১৭ই মে বিশ্বে উচ্চ রক্তচাপ দিবস পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও দিবসটিতে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘উচ্চ রক্তচাপ: সঠিকভাবে পরিমাপ করুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন, দীর্ঘদিন বাঁচুন’।
৬৪% রোগী ওষুধ সেবন করে না
বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সী ঊর্ধ্ব যে ২১ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তাদের মাত্র ১ শতাংশ রোগী সরকারি চিকিৎসা পাচ্ছে। সে হিসাবে তিন কোটি রোগীর মধ্যে সরকারিভাবে নিবন্ধিত হয়েছে ৮৯ হাজারের মতো এবং এসব রোগীর ৫৪টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে নিয়মিতভাবে এক মাসের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে এবং ফলোআপ করা হচ্ছে।
সরকার আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে রোগটির প্রাদুর্ভাব ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে ২০১৮ সাল থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অথচ লক্ষ্যমাত্রার ৪৪২টি উপজেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ২০০ উপজেলায় এনসিডি (নন-কমিউনিকেবল বা অসংক্রামক ব্যাধি) কর্নার স্থাপন করা গেছে। এসব উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে অনিয়মিতভাবে রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৮০ উপজেলায় ডিজিটাল কর্নারে রোগীর তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে। আর গত চার বছরে ৫৪ উপজেলায় মাত্র এক লাখের মতো রোগীকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে পেরেছে সরকার।
এসব রোগীকে সরকার তিনটি ওষুধ বিনামূল্যে দিচ্ছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মৌলিক সাত-আট ধরন ও সমন্বিত ওষুধ মিলে বাজারে ১০-১২ রকমের উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ আছে। এর মধ্যে সরকার বিনামূল্যে দিচ্ছে তিন রকম অ্যামলোডিপাইন, লোসারটান ও হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড। এর মধ্যে প্রথম দুটো সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস থেকে দেওয়া হয় ও তৃতীয়টা সরকারি অপারেশন প্ল্যান থেকে উপজেলাগুলোতে সরবরাহ করে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সরবরাহ থাকলেও সেখানে রোগটির আলাদা চিকিৎসা নেই। এমনকি ৫৪ উপজেলার বাইরে অন্যান্য উপজেলায় এখনো নিয়মিতভাবে ওষুধ পাচ্ছে না রোগীরা। সরকারি সার্ভিলেন্স ও বেসরকারি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অর্ধেক নারী (৫১%) এবং দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষই (৬৭%) জানে না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই (৬৪%) কোনো ওষুধ সেবন করে না। এমনকি প্রতি ১০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৭টিতে উচ্চ রক্তচাপজনিত চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। তবে উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন রয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছে মাত্র ২৯ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে।
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৮ মে, ২০২২, 10:52 PM
উচ্চ রক্তচাপ একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা। উচ্চ রক্তচাপ থাকা ৫০ শতাংশের বেশিই জানেন না তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
বিশ্বে প্রতিবছর এক কোটিরও বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপের কারণে মারা যায়, যা সকল সংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি। বাংলাদেশে প্রতি ৫ জনে ১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। উচ্চ রক্তচাপের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। দেশে এ বিষয়ে গণসচেতনতা এবং চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, অতিরিক্ত লবণ বন্ধ করতে পারলে ৫০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যেতো। একজন মানুষের প্রতিদিন ৫ গ্রাম লবণ প্রয়োজন অর্থাৎ এক চামচ। কিন্তু তার বেশি তারা খাচ্ছেন। জেনে খাচ্ছেন আবার না জেনেও খাচ্ছেন। ঘরে তিনি জেনে খাচ্ছেন। আর ঘরের বাইরে যে খাবার খাচ্ছেন, তাতে কি পরিমাণ লবণ আছে, তা না জেনেই খাচ্ছেন। যেমন চিপসে ১০ গ্রাম লবণ থাকে। তা অনেকেই জানেন না। মানুষ শিঙ্গাড়া, ছমুচা বা হোটেল- রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন খাবার খাচ্ছেন, তাতে কী পরিমাণ লবণ রয়েছে তা তিনি না জেনেই খাচ্ছেন। ফলে শরীরে ঢুকছে মাত্রাতিরিক্ত লবণ। ঘরে লবণ খাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পরিবারের সদস্য হিসেবে তরকারিতে ঠিক ক’চামচ লবণ দেয়া দরকার, তার বেশি নয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি, যা ২০৩০ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে ৩ কোটি ৮০ লাখ। তাই বিশেষজ্ঞরা স্কিনিংয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন।
হাসপাতালটির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম জুবায়ের এ প্রসঙ্গে বলেন, ১৮ বছর বয়সে ব্লাড পেশার মাপবেন। যদি দেখেন নরমাল। ছয় মাস এক বছরের মধ্যে মাপতে হবে না। এক বছর পরে আবার মাপবেন।
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, প্রথমে স্কিনিং করতে হবে। স্কিনিংয়ে আসার পর যাদের আছে। তাদের সেই হিসেবে ট্রিটমেন্ট দেয়া। আর যাদের নেই তাদের যাতে না হয় সে হিসেবে কি কি লাইফস্টাইল চেঞ্জ করতে হবে সে বিষয়ে আমরা বলবো। প্রথম কাজ হচ্ছে সবাইকে স্কিনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, অধিকাংশ সময় উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ এবং উপসর্গ থাকে না অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপে ভোগা অনেক রোগী জানেনই না যে, তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এ জন্য উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সকালের দিকে মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, হৃৎপিণ্ডের অনিয়মিত ছন্দ, দৃষ্টিতে পরিবর্তন এবং কানে গুঞ্জন অনুভূত প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অত্যধিক উচ্চ রক্তচাপ ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, বমি, বিভ্রান্তি, উদ্বেগ, বুকে ব্যথা এবং পেশী কম্পনের কারণ হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করার একমাত্র উপায় হলো চিকিৎসক বা পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা রক্তচাপ পরিমাপ করা। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা না হলে, এটি ধমনি এবং মানবদেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এমনকি ধমনি শক্ত হয়ে হৃৎপিণ্ডে রক্ত ও অক্সিজেনের প্রবাহ হ্রাস পেতে পারে। ফলে বুকে ব্যথা বা অ্যানজাইনা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইল এবং হার্ট বিট অনিয়মিত হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ অর্থাৎ স্ট্রোক হতে পারে। এ ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি বিকলও হয়ে যেতে পারে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন, খাদ্যের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ (সোডিয়াম) গ্রহণ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার, তামাক ও অ্যালকোহল সেবন উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে যেমন, শারীরিকভাবে কর্মঠ না থাকা, অতিরিক্ত ওজন, মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি না খাওয়া। এ ছাড়াও পারিবারিকভাবে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস থাকলে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে (৬৫ বছরের পরে) এবং ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ‘বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে, ২০১৮’ অনুযায়ী ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ২১ শতাংশ (নারী ২৪.১ শতাংশ, পুরুষ ১৭.৯ শতাংশ) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত এবং এদের মধ্যে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে মাত্র ১৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে একজনেরও কম। অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮’ অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৭-১৮ সাল সময়ের মধ্যে, ৩৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশে এবং নারীর ক্ষেত্রে এই হার ৩২ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রয়েছে এমন নারী এবং পুরুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার যথাক্রমে ৪৯ শতাংশ এবং ৪২ শতাংশ, যেখানে স্বাভাবিক ওজনের নারী এবং পুরুষের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ২৫ শতাংশ এবং ২৪ শতাংশ। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অর্ধেক নারী (৫১ শতাংশ) এবং দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষই (৬৭ শতাংশ) জানে না যে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই (৬৪ শতাংশ) কোনো ওষুধ সেবন করে না। আরেকটি গবেষণায় ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ। বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মারা যায়, যার অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। ডব্লিউএইচও’র তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ লক্ষাধিক মানুষ অসংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করেন, যার প্রায় অর্ধেক হৃদরোগজনিত।
উচ্চ রক্তচাপ কী ও এর লক্ষণ : রক্তচাপ যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেড়ে যায় তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের রক্তচাপের পরিমাপ ১২০/৮০ মি.মি. পারদচাপ ধরা হয়ে থাকে। রক্তচাপের এই মাত্রা দুইটি ভিন্ন দিনে ১৪০/৯০ মি.মি. পারদচাপ বা তার বেশি হলে বুঝতে হবে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। তবে বয়স নির্বিশেষে রক্তচাপ কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে। ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে ১৩০/৮০ মি.মি. পারদচাপ-এর অধিক হলে তা উচ্চ রক্তচাপের পর্যায়ে পড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে ১৭ই মে বিশ্বে উচ্চ রক্তচাপ দিবস পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও দিবসটিতে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘উচ্চ রক্তচাপ: সঠিকভাবে পরিমাপ করুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন, দীর্ঘদিন বাঁচুন’।
৬৪% রোগী ওষুধ সেবন করে না
বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সী ঊর্ধ্ব যে ২১ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তাদের মাত্র ১ শতাংশ রোগী সরকারি চিকিৎসা পাচ্ছে। সে হিসাবে তিন কোটি রোগীর মধ্যে সরকারিভাবে নিবন্ধিত হয়েছে ৮৯ হাজারের মতো এবং এসব রোগীর ৫৪টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে নিয়মিতভাবে এক মাসের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে এবং ফলোআপ করা হচ্ছে।
সরকার আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে রোগটির প্রাদুর্ভাব ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে ২০১৮ সাল থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অথচ লক্ষ্যমাত্রার ৪৪২টি উপজেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ২০০ উপজেলায় এনসিডি (নন-কমিউনিকেবল বা অসংক্রামক ব্যাধি) কর্নার স্থাপন করা গেছে। এসব উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে অনিয়মিতভাবে রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৮০ উপজেলায় ডিজিটাল কর্নারে রোগীর তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে। আর গত চার বছরে ৫৪ উপজেলায় মাত্র এক লাখের মতো রোগীকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে পেরেছে সরকার।
এসব রোগীকে সরকার তিনটি ওষুধ বিনামূল্যে দিচ্ছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মৌলিক সাত-আট ধরন ও সমন্বিত ওষুধ মিলে বাজারে ১০-১২ রকমের উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ আছে। এর মধ্যে সরকার বিনামূল্যে দিচ্ছে তিন রকম অ্যামলোডিপাইন, লোসারটান ও হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড। এর মধ্যে প্রথম দুটো সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস থেকে দেওয়া হয় ও তৃতীয়টা সরকারি অপারেশন প্ল্যান থেকে উপজেলাগুলোতে সরবরাহ করে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সরবরাহ থাকলেও সেখানে রোগটির আলাদা চিকিৎসা নেই। এমনকি ৫৪ উপজেলার বাইরে অন্যান্য উপজেলায় এখনো নিয়মিতভাবে ওষুধ পাচ্ছে না রোগীরা। সরকারি সার্ভিলেন্স ও বেসরকারি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অর্ধেক নারী (৫১%) এবং দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষই (৬৭%) জানে না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই (৬৪%) কোনো ওষুধ সেবন করে না। এমনকি প্রতি ১০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৭টিতে উচ্চ রক্তচাপজনিত চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। তবে উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন রয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছে মাত্র ২৯ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে।