করোনা টিকায় রেকর্ড করল বাংলাদেশ: সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ ও দূরদর্শিতায় এ সাফল্য
এসএম শামসুজ্জোহা
১৭ অক্টোবর, ২০২২, 1:14 AM
করোনা টিকায় রেকর্ড করল বাংলাদেশ: সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ ও দূরদর্শিতায় এ সাফল্য
ঢাকা, ১৬ অক্টোবর, ২০২২: বাংলাদেশের মানুষকে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগের লক্ষ্য নিয়ে মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। সার্বিক এই মহাপরিকল্পনায়, কোন পর্যায়ে কোভিড-১৯, করোনা ভ্যাকসিন পাবে কারা, নিবন্ধন প্রক্রিয়া, ভ্যাকসিন সংরক্ষণ কীভাবে হবে, কীভাবে পৌঁছবে সাধারণ মানুষের কাছে, টিকাদান কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা ও টিকা প্রয়োগকারী দলে কারা থাকবে, টিকাদান-পরবর্তী বিরূপ ঘটনা তদারকিসহ সবকিছুর পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সরকার অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
জানা গেছে, মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপ রোধে সরকারের অন্যতম কৌশল ছিল দ্রুত সময়ে নির্ধারিত জনগোষ্ঠিকে টিকার আওতায় আনা। এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) বাংলাদেশকে সময়সীমা নির্ধারণ করেছিল ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে নির্ধারিত সময়ে চার দিন আগেই বাংলাদেশ এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাইলফলক স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন ডেপ্লোয়মেন্ট কমিটি (করোনার টিকা প্রয়োগ কমিটির সদস্য সচিব) ডা. মো. শামসুল হক এ তথ্য নিশ্চত করে তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে করোনার পূর্ণ দুই ডোজ টিকা দিতে পেরেছি। এটা আমাদের একটি বড় সাফল্য।’ তিনি আরও বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে স্বাস্থ্যবিভাগের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বিত পদক্ষেপ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দাতা দেশগুলো যারা টিকা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। সবচেয়ে বেশি অবদান হলো দেশের মানুষের, যারা করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে টিকা নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে প্রথম গণটিকা কর্মসূচিতে এক কোটি প্রথম ডোজ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিল সরকার। সেখানে দেওয়া হয়েছে এক কোটি ১১ লাখ ৭৪ হাজার ৭২৫ ডোজ। এক দিনে এক কোটির বেশি করোনার টিকা দেওয়ার রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ।
পাশাপাশি একই দিন টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে আট লাখ ১৫ হাজার ৭৩ ও বুস্টার বা তৃতীয় ডোজ ৭৩ হাজার ৮৫৫। অর্থাৎ এক দিনে প্রথম, দ্বিতীয় ও বুস্টার মিলে এক কোটি ২০ লাখ ৬৩ হাজার ৬৫৩ ডোজ টিকা দিয়েছে সরকার। এর মধ্য দিয়ে ভারতের পর বাংলাদেশই এক দিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক টিকা দেওয়ার রেকর্ড করল। এর আগে গত বছরের ৩১ আগস্ট ভারতে এক দিনে এক কোটি ২৮ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ ডোজ করোনার টিকা দেওয়া হয়। তারও আগে ২৭ আগস্ট এক দিনে এক কোটি টিকা দেয় দেশটি। তখন এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইটারে এক বক্তব্যে এই মাইলফলককে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশটির জন্য একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ অর্জন’ হিসেবে প্রশংসা করেন।
সম্প্রতি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রায় চার হাজার নবনিয়োগকৃত চিকিৎসকের ওরিয়েন্টেশন কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক বলেন, এক দিনে এক কোটির বেশি টিকা দেওয়ার এই রেকর্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে টিকার বৈশ্বিক তালিকায় আরও দুই ধাপ এগিয়ে গেল। সম্পূর্ণ টিকা প্রদানে সেখান থেকে আরও তিন ধাপ উপরে উঠে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ৮ম। এমনকি বাংলাদেশ এখন প্রথম, দ্বিতীয় ও বুস্টার ডোজ মিলে মোট টিকার তালিকায়ও চার ধাপ উপরে উঠে ৭ম অবস্থানে রয়েছে।
কোভিড-১৯ টিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারি হিসাবে দেশে মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি তিন লাখ ১৭ হাজার ৭৭ জন। মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ১১ কোটি ৯২ লাখ ২১ হাজার ৯৫৪ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ দেশের মোট জনসংখ্যা অনুপাতে টিকার আওতায় এসেছেন ৭১ শতাংশ মানুষ।
সম্পূর্ণ টিকায় ৮ নম্বরে: ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা বা ওডব্লিউআইডি’র তথ্য অনুযায়ী, করোনা টিকার বৈশ্বিক তালিকায় ২২০টি দেশের মধ্যে দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে সম্পূর্ণ টিকাগ্রহীতার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১ নম্বরে। সেখানে আরও তিন ধাপ ওপরে উঠে ৮ম অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে পাকিস্তান, সেখানে সম্পূর্ণ টিকা পেয়েছেন ৯ কোটি ৬২ লাখ মানুষ এবং বাংলাদেশের নিচে নবম অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো, সেখানে সম্পূর্ণ টিকা পেয়েছেন সাত কোটি ৮৮ লাখ মানুষ। শীর্ষ সাতটি দেশের মধ্যে চীনে সম্পূর্ণ টিকা নিয়েছেন ১২৩ কোটি, ভারতে ৭৮ কোটি আট লাখ, যুক্তরাষ্ট্রে ২১ কোটি পাঁচ লাখ, ব্রাজিলে ১৫ কোটি পাঁচ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ১৪ কোটি চার লাখ ও জাপানে ১০ কোটি মানুষ।
অন্যদিকে, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ মিলে মোট টিকা দেওয়ার বৈশ্বিক তালিকায়ও চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। টিকার বৈশ্বিক তালিকায় ২২০টি দেশের মধ্যে মোট টিকা প্রদানের তালিকায় বাংলাদেশে অবস্থান ছিল ১১ নম্বরে। সেখান থেকেও বাংলাদেশ চার ধাপ উপরে উঠে ৭ম অবস্থানে দাঁড়িয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সংক্রমণ কমতে কমতে শনাক্তের হার নেমে এসেছিল ২-এর ঘরে। গত বছরের ১৬ জুলাই এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্তের খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেদিন শনাক্ত ছিল তিন হাজার ৭৩৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ সরকারিভাবে প্রথম মৃত্যুর ঘোষণা আসে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। চলতি বছর মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্তের হার ছিল ২০ শতাংশের ওপরে। দেশে এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষ, আর শনাক্ত হয়েছেন প্রায় ২০ লাখ। এর মধ্যে টিকা নিয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ৯৩৬ জনের শরীরে। বিজ্ঞজনের মতে, বিশ্বের অনেক দেশ এখনও এত পরিমাণ ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে না পারলেও বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা কঠিন মনে হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা অতিদ্রুত এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার প্রত্যয় ঘোষণা করে মাঠ পর্যায়ে নিরলস কাজ করে চলছে। দেশে সার্বিক চাহিদা ও লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় ইতোমধ্যে সরকার গত ৮ অক্টোবর করোনা প্রথম ডোজ টিকা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে।
টিকার সার্বিক চিত্রে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছিলেন, বাংলাদেশ করোনা টিকায় অবশ্যই সফল। আমাদের মতো একটি দেশে লিমিটেড রিসোর্স নিয়ে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনা বিশাল চ্যালেঞ্জ। টিকাদানে সরকার সে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
এদিকে উৎসবমুখর আনন্দঘন পরিবেশে ভ্যাকসিন গ্রহণে দেশবাসীকে নতুন মাত্রিকতায় উদ্বুদ্ধ করার যে বিরল নজির স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনার বৈশ্বিক ক্রান্তিকাল অতিক্রমে ধরিত্রীর ক্ষুদ্র আয়তনের বিপুল জনঅধ্যুষিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও সামগ্রিকভাবে সমরূপ ক্ষত-বিক্ষত। স্রষ্টার অপার কৃপায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার কর্তৃক গৃহীত স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা উদ্যোগ এবং সমান্তরালভাবে অর্থনীতিকে সচল রাখার নির্ভীক পদক্ষেপ গ্রহণ ছিল যুগান্তকারী। প্রজ্ঞা-মেধা-বিচক্ষণতার অনবদ্য রসায়নে নানামুখী উৎপাদনশীল কর্মযজ্ঞ অধিকাংশ ক্ষেত্রে করোনা জয়ে অসাধারণ অবদান রেখে চলছে। বিগত অক্টোবর মাসে করোনা দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়াবহতার আগাম উপলব্ধিতে চলমান প্রক্রিয়াকে অধিকতর সক্রিয় করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ জোগানের প্রয়োজনীয়তায় সরকারি ব্যয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান ছিল অত্যন্ত যুগোপযোগী। অসহায় ও দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত দেশবাসীকে চিকিৎসা সেবা এবং প্রণোদনা সহযোগিতায় জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার সংগ্রাম সম্পর্কে জোরালো সতর্কবার্তাও দেয়া হয়েছিল। ফলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় করোনা সংক্রমণ উত্তরণে ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও প্রয়োগে যথাযথ কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যনির্ভর উদ্ভাবনী পন্থা অবলম্বন করে সরকার অর্জন করেছে অভূতপূর্ব সাফল্য।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম করোনা টিকাদান শুরু হয়। এর মধ্যে ছিল অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, সিনোফার্ম, মডার্না, সিনোভ্যাক ও জনসন।
এসএম শামসুজ্জোহা
১৭ অক্টোবর, ২০২২, 1:14 AM
ঢাকা, ১৬ অক্টোবর, ২০২২: বাংলাদেশের মানুষকে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগের লক্ষ্য নিয়ে মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। সার্বিক এই মহাপরিকল্পনায়, কোন পর্যায়ে কোভিড-১৯, করোনা ভ্যাকসিন পাবে কারা, নিবন্ধন প্রক্রিয়া, ভ্যাকসিন সংরক্ষণ কীভাবে হবে, কীভাবে পৌঁছবে সাধারণ মানুষের কাছে, টিকাদান কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা ও টিকা প্রয়োগকারী দলে কারা থাকবে, টিকাদান-পরবর্তী বিরূপ ঘটনা তদারকিসহ সবকিছুর পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সরকার অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
জানা গেছে, মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপ রোধে সরকারের অন্যতম কৌশল ছিল দ্রুত সময়ে নির্ধারিত জনগোষ্ঠিকে টিকার আওতায় আনা। এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) বাংলাদেশকে সময়সীমা নির্ধারণ করেছিল ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে নির্ধারিত সময়ে চার দিন আগেই বাংলাদেশ এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাইলফলক স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন ডেপ্লোয়মেন্ট কমিটি (করোনার টিকা প্রয়োগ কমিটির সদস্য সচিব) ডা. মো. শামসুল হক এ তথ্য নিশ্চত করে তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে করোনার পূর্ণ দুই ডোজ টিকা দিতে পেরেছি। এটা আমাদের একটি বড় সাফল্য।’ তিনি আরও বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে স্বাস্থ্যবিভাগের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বিত পদক্ষেপ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দাতা দেশগুলো যারা টিকা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। সবচেয়ে বেশি অবদান হলো দেশের মানুষের, যারা করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে টিকা নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে প্রথম গণটিকা কর্মসূচিতে এক কোটি প্রথম ডোজ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিল সরকার। সেখানে দেওয়া হয়েছে এক কোটি ১১ লাখ ৭৪ হাজার ৭২৫ ডোজ। এক দিনে এক কোটির বেশি করোনার টিকা দেওয়ার রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ।
পাশাপাশি একই দিন টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে আট লাখ ১৫ হাজার ৭৩ ও বুস্টার বা তৃতীয় ডোজ ৭৩ হাজার ৮৫৫। অর্থাৎ এক দিনে প্রথম, দ্বিতীয় ও বুস্টার মিলে এক কোটি ২০ লাখ ৬৩ হাজার ৬৫৩ ডোজ টিকা দিয়েছে সরকার। এর মধ্য দিয়ে ভারতের পর বাংলাদেশই এক দিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক টিকা দেওয়ার রেকর্ড করল। এর আগে গত বছরের ৩১ আগস্ট ভারতে এক দিনে এক কোটি ২৮ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ ডোজ করোনার টিকা দেওয়া হয়। তারও আগে ২৭ আগস্ট এক দিনে এক কোটি টিকা দেয় দেশটি। তখন এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইটারে এক বক্তব্যে এই মাইলফলককে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশটির জন্য একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ অর্জন’ হিসেবে প্রশংসা করেন।
সম্প্রতি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রায় চার হাজার নবনিয়োগকৃত চিকিৎসকের ওরিয়েন্টেশন কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক বলেন, এক দিনে এক কোটির বেশি টিকা দেওয়ার এই রেকর্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে টিকার বৈশ্বিক তালিকায় আরও দুই ধাপ এগিয়ে গেল। সম্পূর্ণ টিকা প্রদানে সেখান থেকে আরও তিন ধাপ উপরে উঠে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ৮ম। এমনকি বাংলাদেশ এখন প্রথম, দ্বিতীয় ও বুস্টার ডোজ মিলে মোট টিকার তালিকায়ও চার ধাপ উপরে উঠে ৭ম অবস্থানে রয়েছে।
কোভিড-১৯ টিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারি হিসাবে দেশে মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি তিন লাখ ১৭ হাজার ৭৭ জন। মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ১১ কোটি ৯২ লাখ ২১ হাজার ৯৫৪ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ দেশের মোট জনসংখ্যা অনুপাতে টিকার আওতায় এসেছেন ৭১ শতাংশ মানুষ।
সম্পূর্ণ টিকায় ৮ নম্বরে: ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা বা ওডব্লিউআইডি’র তথ্য অনুযায়ী, করোনা টিকার বৈশ্বিক তালিকায় ২২০টি দেশের মধ্যে দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে সম্পূর্ণ টিকাগ্রহীতার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১ নম্বরে। সেখানে আরও তিন ধাপ ওপরে উঠে ৮ম অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে পাকিস্তান, সেখানে সম্পূর্ণ টিকা পেয়েছেন ৯ কোটি ৬২ লাখ মানুষ এবং বাংলাদেশের নিচে নবম অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো, সেখানে সম্পূর্ণ টিকা পেয়েছেন সাত কোটি ৮৮ লাখ মানুষ। শীর্ষ সাতটি দেশের মধ্যে চীনে সম্পূর্ণ টিকা নিয়েছেন ১২৩ কোটি, ভারতে ৭৮ কোটি আট লাখ, যুক্তরাষ্ট্রে ২১ কোটি পাঁচ লাখ, ব্রাজিলে ১৫ কোটি পাঁচ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ১৪ কোটি চার লাখ ও জাপানে ১০ কোটি মানুষ।
অন্যদিকে, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ মিলে মোট টিকা দেওয়ার বৈশ্বিক তালিকায়ও চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। টিকার বৈশ্বিক তালিকায় ২২০টি দেশের মধ্যে মোট টিকা প্রদানের তালিকায় বাংলাদেশে অবস্থান ছিল ১১ নম্বরে। সেখান থেকেও বাংলাদেশ চার ধাপ উপরে উঠে ৭ম অবস্থানে দাঁড়িয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সংক্রমণ কমতে কমতে শনাক্তের হার নেমে এসেছিল ২-এর ঘরে। গত বছরের ১৬ জুলাই এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্তের খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেদিন শনাক্ত ছিল তিন হাজার ৭৩৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ সরকারিভাবে প্রথম মৃত্যুর ঘোষণা আসে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। চলতি বছর মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্তের হার ছিল ২০ শতাংশের ওপরে। দেশে এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষ, আর শনাক্ত হয়েছেন প্রায় ২০ লাখ। এর মধ্যে টিকা নিয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ৯৩৬ জনের শরীরে। বিজ্ঞজনের মতে, বিশ্বের অনেক দেশ এখনও এত পরিমাণ ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে না পারলেও বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা কঠিন মনে হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা অতিদ্রুত এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার প্রত্যয় ঘোষণা করে মাঠ পর্যায়ে নিরলস কাজ করে চলছে। দেশে সার্বিক চাহিদা ও লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় ইতোমধ্যে সরকার গত ৮ অক্টোবর করোনা প্রথম ডোজ টিকা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে।
টিকার সার্বিক চিত্রে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছিলেন, বাংলাদেশ করোনা টিকায় অবশ্যই সফল। আমাদের মতো একটি দেশে লিমিটেড রিসোর্স নিয়ে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনা বিশাল চ্যালেঞ্জ। টিকাদানে সরকার সে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
এদিকে উৎসবমুখর আনন্দঘন পরিবেশে ভ্যাকসিন গ্রহণে দেশবাসীকে নতুন মাত্রিকতায় উদ্বুদ্ধ করার যে বিরল নজির স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনার বৈশ্বিক ক্রান্তিকাল অতিক্রমে ধরিত্রীর ক্ষুদ্র আয়তনের বিপুল জনঅধ্যুষিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও সামগ্রিকভাবে সমরূপ ক্ষত-বিক্ষত। স্রষ্টার অপার কৃপায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার কর্তৃক গৃহীত স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা উদ্যোগ এবং সমান্তরালভাবে অর্থনীতিকে সচল রাখার নির্ভীক পদক্ষেপ গ্রহণ ছিল যুগান্তকারী। প্রজ্ঞা-মেধা-বিচক্ষণতার অনবদ্য রসায়নে নানামুখী উৎপাদনশীল কর্মযজ্ঞ অধিকাংশ ক্ষেত্রে করোনা জয়ে অসাধারণ অবদান রেখে চলছে। বিগত অক্টোবর মাসে করোনা দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়াবহতার আগাম উপলব্ধিতে চলমান প্রক্রিয়াকে অধিকতর সক্রিয় করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ জোগানের প্রয়োজনীয়তায় সরকারি ব্যয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান ছিল অত্যন্ত যুগোপযোগী। অসহায় ও দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত দেশবাসীকে চিকিৎসা সেবা এবং প্রণোদনা সহযোগিতায় জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার সংগ্রাম সম্পর্কে জোরালো সতর্কবার্তাও দেয়া হয়েছিল। ফলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় করোনা সংক্রমণ উত্তরণে ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও প্রয়োগে যথাযথ কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যনির্ভর উদ্ভাবনী পন্থা অবলম্বন করে সরকার অর্জন করেছে অভূতপূর্ব সাফল্য।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম করোনা টিকাদান শুরু হয়। এর মধ্যে ছিল অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, সিনোফার্ম, মডার্না, সিনোভ্যাক ও জনসন।