দুর্ণীতির দুর্বৃত্তায়নে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

#
news image

দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-ভর্তি-কোচিং বাণিজ্যের দীর্ঘদিনের পুরোনো অভিযোগের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি-গাড়ি ক্রয়, ভবন নির্মাণ, বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কাজের নামে অর্থ লুটের প্রবণতা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত অর্থ এ ব্যাংক থেকে ও ব্যাংকে এফডিআর করে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগও আসছে প্রায়ই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাগামহীন এই দুর্নীতির দ্বারা দুর্নীতিবাজরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেও শিক্ষার মৌলিক অধিকারটি দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে সাধারন মানুষের জন্য ।
বিভিন্ন সূত্রমতে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছে দুর্নীতিবাজ চক্র। এ চক্রের অগ্রভাগে কোথাও অসাধু শিক্ষক আবার কোথাও কর্মচারীরা থাকেন। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রে এর নেপথ্যে আছেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির (জিবি বা এসএমসি) দুর্নীতিবাজ সভাপতি, অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষক।
অনিয়ম-দুর্নীতি নির্বিঘ্ন করতে কোথাও প্রভাবশালী শিক্ষক এবং গভর্নিং বডির কোনো কোনো শিক্ষক ও অভিভাবক প্রতিনিধিকেও সম্পৃক্ত করা হয়। আবার দুর্নীতি থেকে পার পেতে কখনো তারা ¯’ানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে চলে যান। সমাজের প্রভাবশালীদেরও সামনে রাখেন কেউ কেউ। এভাবে দুর্নীতিবাজরা মিলে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যত নামডাক, সেই প্রতিষ্ঠান ঘিরে দুর্নীতিবাজদের তৎপরতাও তত বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এসব দুর্নীতিবাজদের কেউ কেউ একাধিক গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, সুপারশপ, হাসপাতাল এমনকি ডেভেলপার কোম্পানির মালিক বনে গেছেন। 
অনেকের সম্পদের সঙ্গে আয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই। তবে দুর্নীতিবাজদের বেশিরভাগের তথ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আছে। বিভিন্ন সংস্থার তদন্তের মাধ্যমেও কিছু তথ্য উঠে এসেছে। আর কিছু এসেছে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের মাধ্যমে। কিন্তু আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যবস্থা নিতে পারছে না মন্ত্রণালয়।
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ আসাদুল হক সেলিম প্রভাতী খবরকে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটির পদ লাভজনক ও লোভনীয় হয়ে উঠেছে বলে প্রায়ই অভিযোগ আসছে। যে প্রতিষ্ঠান যত বড়, তত বড় তার দুর্নীতি। আর দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতি করে কমিটির কাউকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। অপরদিকে কমিটি পক্ষে থাকলে অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষকসহ অন্যরাও রেহাই পেয়ে যান’।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১ হাজার সরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা আছে। মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৩৭ হাজার। এরমধ্যে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান ২৯ হাজার ১৬৪টি। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতির ঘটনা আছে। লুটপাটের অভিযোগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই বেশি হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সভাপতিসহ পর্ষদকে বিধিমালায় একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতার জোরেই তাদের অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজন শিক্ষক বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার কেদ্রবিন্দু বলতে আগে অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষককে বোঝানো হলেও বর্তমানে কমিটিই সব। 
আবার আয়-ব্যয়ের সকল হিসাব-নিকাশ এর দায়িত্ব প্রতিষ্ঠান প্রধান এর উপর থাকার কারনে সভাপতিসহ কমিটির সদস্যরা দুর্নীতি করলে তার দায়ভারও প্রতিষ্ঠান প্রধানকেই নিতে হয়। 
আবার যেহেতু, পরিচালনা পর্ষদের হাতে প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ অন্যান্য সকলের চাকরি থাকা-না থাকা নির্ভর করে, তাই অনেক ক্ষেত্রেই পর্ষদের অন্যায় দাবী মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না তাদের। 
সংশ্লিষ্টরা বলেন, বিধিমালায় সভাপতি-সদস্য বা পর্ষদকে কর্মকাণ্ডের দায় থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। শাস্তি বলতে সর্বোচ্চ কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। আইনে বিচারের রাস্তা না থাকায় দুর্নীতিবাজ পর্ষদ ও সিন্ডিকেটে সাধারণ শিক্ষকরাও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। 
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির কার্যক্রম নিয়ে গত জুনে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এতে দুর্নীতির নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। প্রতিবেদনের একটি অংশে স্কুল-কলেজে অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লাখ থেকে ১৮ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্যের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই টাকা দিতে হয় ¯’ানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পরিচালনা কমিটিকে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা ডিআইএর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩১৬ দশমিক ৭০ একর জমি বেহাত হয়ে গেছে। দেশের ৮৯৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলাদাভাবে দুই সময়ে পরিদর্শন করে সংস্থাটি এই চিত্র পেয়েছে। এসব জমির কোনোটি পরিচালনা কমিটি আর শিক্ষকরা মিলে বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার কোনোটি নিজেদের নামে লিখে নিয়েছেন। 
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, ‘সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই যে দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে এমন নয়। শহরকেন্দ্রিক বড় কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে অভিযোগ বেশী আসছে।’ 
তিনি আরো বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসে, তা তদন্ত করে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। যেহেতু আইন অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার যার, বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুতির ক্ষমতাও তার। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রবিধান অনুযায়ী এ এখতিয়ার পরিচালনা কমিটিকে দেওয়া আছে। তাই কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নিতে কমিটিগুলোকে বলা হয়। এর বেশি কিছু করা যাচ্ছে না’। 
আবু বকর ছিদ্দীক আরও বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। পরিচালনা কমিটি বা ব্যক্তিবিশেষ অনৈতিক কাজ করলে কী শাস্তি দেওয়া যাবে, তা নীতিমালায় নেই। এ কারণে পরিচালনা কমিটি গঠন প্রবিধানমালা হালনাগাদ এবং আয়-ব্যয় সংক্রান্ত একটি নতুন নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’
অভিভাবকরা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অপরাধের যথাযথ বিচার হলে অপরাধ অনেকটাই কমে যেত। ঢাকার অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবীর দুলু বলেন, যে কোনো অপরাধের বিচার না হলে সমাজে ওই অপরাধের অপরাধীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক দুর্নীতির ঘটনায় গ্রেফতার আর কারাবাসের ঘটনা নেই বললেই চলে। 
সম্প্রতি রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের একটি ঘটনা আলোচনায় এসেছে। ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির একাংশের বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্য, উন্নয়ন কাজে নয়ছয়, বদলি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ ওঠে। দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে নানা দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আরও তিনটি কমিটির তদন্ত চলছে। প্রতিষ্ঠানটির চিহ্নিত ও দুর্নীতিবাজ জিবি সদস্যদের আছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গাড়ি। তাদের আয়ের সঙ্গে সম্পদের সামঞ্জস্য নেই। 
আরেক আলোচিত ঘটনা রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজে। প্রতিষ্ঠানটিতে ২০০৪ সালে উপ-প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পান আতিকুর রহমান খান নামে একজন। জানা গেছে, স্কুলে এ ধরনের পদ না থাকলেও নিয়োগ পাওয়া এই ব্যক্তিকে ২০১৫ সালে পদোন্নতি দিয়ে কর্মচারী থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা করা হয়। দেশের একাধিক ব্যাংকে আতিকুরের ৯৭টি হিসাব রয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছর জুন পর্যন্ত এসব হিসাবে ২১০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। এত টাকার উৎস অনুসন্ধানের পদক্ষেপ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসাবে গত ১লা আগস্ট মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) পাঠানো চিঠিতে-আতিকুরের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ তদন্ত করে প্রশাসনিক কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। 
পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) একইদিন পাঠানো আরেক চিঠিতে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করতে বলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদক বিষয়টি নথিভুক্ত করে । দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুব রহমান গত রোববার (আগস্ট ২৮) আতিকুরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে আদালতে আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন ।
সম্প্র্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি-অনিয়মে ডিআইএ সংস্থাটি দুই হাজার প্রতিষ্ঠানে তদন্ত শেষে অর্থ নয়ছয়ের প্রমাণ পেয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন রাজধানীর মিরপুর কলেজের অধ্যক্ষ। গত ৩০ জুন জমা দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় তিনটি ফ্ল্যাট ও গ্রামে তিনতলা বাড়ির মালিক ওই অধ্যক্ষ। সঞ্চয়পত্র আর শেয়ারবাজারে আছে তার বিনিয়োগ। এমনকি তার নিয়োগ নিয়েও তদন্ত প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। 
এভাবে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করেছে ডিআইএ। সংস্থাটির আলোচিত তদন্তগুলোর আরেকটি হলো-রাজধানীর দনিয়া কলেজ। তদন্তে প্রতিষ্ঠানটিতে ৪১ কোটি ৪০ লাখ ৯৪ হাজার টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে। এছাড়া যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, রাজশাহী মসজিদ মিশন স্কুলে বড় ধরনের দুর্নীতি চিত্র বের করেছে সংস্থাটি।
সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিল মডেল স্কুল ও কলেজের সাবেক এক সভাপতির নানা অন্যায়-অনিয়ম ও লুটপাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষকরা। তাদের অভিযোগ-তিন বছরে স্কুলের অন্তত ৩৫ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। 
অভিযোগ রয়েছে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় অবস্থিত একটি কলেজের তহবিলের টাকার বেশ বড় একটি অংশ লোপাট করেছেন পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। এতে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। 
ডিআইএ'র যুগ্মপরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার প্রভাতি খবরকে বলেন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন, নিরীক্ষা ও তদন্তে আর্থিক দুর্নীতিই বেশি বের হয়ে আসছে। এছাড়া টিউশনসহ বিভিন্ন ফিসহ নানা বিষয়ে বেআইনি ঘটনা ঘটছে। আগে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি বেশি হতো। 
কয়েক বছর ধরে সরকার প্রবেশপদে নিয়োগ দিচ্ছেছ। এরপরও কিছু প্রতিষ্ঠান নতুন সৃষ্ট পদের নামে নিজেরা নিয়োগ করছে। সেগুলোও বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। সুশাসনের প্রয়োজনে অধ্যক্ষ এবং কর্মচারী নিয়োগও সরকারিভাবে করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

এসএম শামসুজ্জোহা

০৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২,  9:15 PM

news image

দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-ভর্তি-কোচিং বাণিজ্যের দীর্ঘদিনের পুরোনো অভিযোগের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি-গাড়ি ক্রয়, ভবন নির্মাণ, বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কাজের নামে অর্থ লুটের প্রবণতা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত অর্থ এ ব্যাংক থেকে ও ব্যাংকে এফডিআর করে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগও আসছে প্রায়ই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাগামহীন এই দুর্নীতির দ্বারা দুর্নীতিবাজরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেও শিক্ষার মৌলিক অধিকারটি দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে সাধারন মানুষের জন্য ।
বিভিন্ন সূত্রমতে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছে দুর্নীতিবাজ চক্র। এ চক্রের অগ্রভাগে কোথাও অসাধু শিক্ষক আবার কোথাও কর্মচারীরা থাকেন। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রে এর নেপথ্যে আছেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির (জিবি বা এসএমসি) দুর্নীতিবাজ সভাপতি, অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষক।
অনিয়ম-দুর্নীতি নির্বিঘ্ন করতে কোথাও প্রভাবশালী শিক্ষক এবং গভর্নিং বডির কোনো কোনো শিক্ষক ও অভিভাবক প্রতিনিধিকেও সম্পৃক্ত করা হয়। আবার দুর্নীতি থেকে পার পেতে কখনো তারা ¯’ানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে চলে যান। সমাজের প্রভাবশালীদেরও সামনে রাখেন কেউ কেউ। এভাবে দুর্নীতিবাজরা মিলে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যত নামডাক, সেই প্রতিষ্ঠান ঘিরে দুর্নীতিবাজদের তৎপরতাও তত বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এসব দুর্নীতিবাজদের কেউ কেউ একাধিক গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, সুপারশপ, হাসপাতাল এমনকি ডেভেলপার কোম্পানির মালিক বনে গেছেন। 
অনেকের সম্পদের সঙ্গে আয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই। তবে দুর্নীতিবাজদের বেশিরভাগের তথ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আছে। বিভিন্ন সংস্থার তদন্তের মাধ্যমেও কিছু তথ্য উঠে এসেছে। আর কিছু এসেছে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের মাধ্যমে। কিন্তু আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যবস্থা নিতে পারছে না মন্ত্রণালয়।
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ আসাদুল হক সেলিম প্রভাতী খবরকে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটির পদ লাভজনক ও লোভনীয় হয়ে উঠেছে বলে প্রায়ই অভিযোগ আসছে। যে প্রতিষ্ঠান যত বড়, তত বড় তার দুর্নীতি। আর দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতি করে কমিটির কাউকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। অপরদিকে কমিটি পক্ষে থাকলে অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষকসহ অন্যরাও রেহাই পেয়ে যান’।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১ হাজার সরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা আছে। মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৩৭ হাজার। এরমধ্যে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান ২৯ হাজার ১৬৪টি। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতির ঘটনা আছে। লুটপাটের অভিযোগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই বেশি হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সভাপতিসহ পর্ষদকে বিধিমালায় একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতার জোরেই তাদের অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজন শিক্ষক বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার কেদ্রবিন্দু বলতে আগে অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষককে বোঝানো হলেও বর্তমানে কমিটিই সব। 
আবার আয়-ব্যয়ের সকল হিসাব-নিকাশ এর দায়িত্ব প্রতিষ্ঠান প্রধান এর উপর থাকার কারনে সভাপতিসহ কমিটির সদস্যরা দুর্নীতি করলে তার দায়ভারও প্রতিষ্ঠান প্রধানকেই নিতে হয়। 
আবার যেহেতু, পরিচালনা পর্ষদের হাতে প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ অন্যান্য সকলের চাকরি থাকা-না থাকা নির্ভর করে, তাই অনেক ক্ষেত্রেই পর্ষদের অন্যায় দাবী মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না তাদের। 
সংশ্লিষ্টরা বলেন, বিধিমালায় সভাপতি-সদস্য বা পর্ষদকে কর্মকাণ্ডের দায় থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। শাস্তি বলতে সর্বোচ্চ কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। আইনে বিচারের রাস্তা না থাকায় দুর্নীতিবাজ পর্ষদ ও সিন্ডিকেটে সাধারণ শিক্ষকরাও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। 
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির কার্যক্রম নিয়ে গত জুনে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এতে দুর্নীতির নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। প্রতিবেদনের একটি অংশে স্কুল-কলেজে অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লাখ থেকে ১৮ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্যের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই টাকা দিতে হয় ¯’ানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পরিচালনা কমিটিকে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা ডিআইএর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩১৬ দশমিক ৭০ একর জমি বেহাত হয়ে গেছে। দেশের ৮৯৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলাদাভাবে দুই সময়ে পরিদর্শন করে সংস্থাটি এই চিত্র পেয়েছে। এসব জমির কোনোটি পরিচালনা কমিটি আর শিক্ষকরা মিলে বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার কোনোটি নিজেদের নামে লিখে নিয়েছেন। 
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, ‘সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই যে দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে এমন নয়। শহরকেন্দ্রিক বড় কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে অভিযোগ বেশী আসছে।’ 
তিনি আরো বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসে, তা তদন্ত করে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। যেহেতু আইন অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার যার, বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুতির ক্ষমতাও তার। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রবিধান অনুযায়ী এ এখতিয়ার পরিচালনা কমিটিকে দেওয়া আছে। তাই কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নিতে কমিটিগুলোকে বলা হয়। এর বেশি কিছু করা যাচ্ছে না’। 
আবু বকর ছিদ্দীক আরও বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। পরিচালনা কমিটি বা ব্যক্তিবিশেষ অনৈতিক কাজ করলে কী শাস্তি দেওয়া যাবে, তা নীতিমালায় নেই। এ কারণে পরিচালনা কমিটি গঠন প্রবিধানমালা হালনাগাদ এবং আয়-ব্যয় সংক্রান্ত একটি নতুন নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’
অভিভাবকরা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অপরাধের যথাযথ বিচার হলে অপরাধ অনেকটাই কমে যেত। ঢাকার অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবীর দুলু বলেন, যে কোনো অপরাধের বিচার না হলে সমাজে ওই অপরাধের অপরাধীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক দুর্নীতির ঘটনায় গ্রেফতার আর কারাবাসের ঘটনা নেই বললেই চলে। 
সম্প্রতি রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের একটি ঘটনা আলোচনায় এসেছে। ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির একাংশের বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্য, উন্নয়ন কাজে নয়ছয়, বদলি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ ওঠে। দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে নানা দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আরও তিনটি কমিটির তদন্ত চলছে। প্রতিষ্ঠানটির চিহ্নিত ও দুর্নীতিবাজ জিবি সদস্যদের আছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গাড়ি। তাদের আয়ের সঙ্গে সম্পদের সামঞ্জস্য নেই। 
আরেক আলোচিত ঘটনা রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজে। প্রতিষ্ঠানটিতে ২০০৪ সালে উপ-প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পান আতিকুর রহমান খান নামে একজন। জানা গেছে, স্কুলে এ ধরনের পদ না থাকলেও নিয়োগ পাওয়া এই ব্যক্তিকে ২০১৫ সালে পদোন্নতি দিয়ে কর্মচারী থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা করা হয়। দেশের একাধিক ব্যাংকে আতিকুরের ৯৭টি হিসাব রয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছর জুন পর্যন্ত এসব হিসাবে ২১০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। এত টাকার উৎস অনুসন্ধানের পদক্ষেপ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসাবে গত ১লা আগস্ট মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) পাঠানো চিঠিতে-আতিকুরের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ তদন্ত করে প্রশাসনিক কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। 
পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) একইদিন পাঠানো আরেক চিঠিতে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করতে বলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদক বিষয়টি নথিভুক্ত করে । দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুব রহমান গত রোববার (আগস্ট ২৮) আতিকুরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে আদালতে আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন ।
সম্প্র্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি-অনিয়মে ডিআইএ সংস্থাটি দুই হাজার প্রতিষ্ঠানে তদন্ত শেষে অর্থ নয়ছয়ের প্রমাণ পেয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন রাজধানীর মিরপুর কলেজের অধ্যক্ষ। গত ৩০ জুন জমা দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় তিনটি ফ্ল্যাট ও গ্রামে তিনতলা বাড়ির মালিক ওই অধ্যক্ষ। সঞ্চয়পত্র আর শেয়ারবাজারে আছে তার বিনিয়োগ। এমনকি তার নিয়োগ নিয়েও তদন্ত প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। 
এভাবে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করেছে ডিআইএ। সংস্থাটির আলোচিত তদন্তগুলোর আরেকটি হলো-রাজধানীর দনিয়া কলেজ। তদন্তে প্রতিষ্ঠানটিতে ৪১ কোটি ৪০ লাখ ৯৪ হাজার টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে। এছাড়া যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, রাজশাহী মসজিদ মিশন স্কুলে বড় ধরনের দুর্নীতি চিত্র বের করেছে সংস্থাটি।
সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিল মডেল স্কুল ও কলেজের সাবেক এক সভাপতির নানা অন্যায়-অনিয়ম ও লুটপাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষকরা। তাদের অভিযোগ-তিন বছরে স্কুলের অন্তত ৩৫ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। 
অভিযোগ রয়েছে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় অবস্থিত একটি কলেজের তহবিলের টাকার বেশ বড় একটি অংশ লোপাট করেছেন পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। এতে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। 
ডিআইএ'র যুগ্মপরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার প্রভাতি খবরকে বলেন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন, নিরীক্ষা ও তদন্তে আর্থিক দুর্নীতিই বেশি বের হয়ে আসছে। এছাড়া টিউশনসহ বিভিন্ন ফিসহ নানা বিষয়ে বেআইনি ঘটনা ঘটছে। আগে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি বেশি হতো। 
কয়েক বছর ধরে সরকার প্রবেশপদে নিয়োগ দিচ্ছেছ। এরপরও কিছু প্রতিষ্ঠান নতুন সৃষ্ট পদের নামে নিজেরা নিয়োগ করছে। সেগুলোও বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। সুশাসনের প্রয়োজনে অধ্যক্ষ এবং কর্মচারী নিয়োগও সরকারিভাবে করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।