পেঁয়াজ-আলুতে অশনিসংকেত - বেসামাল  বাজার

#
news image

দেশে আলু-পেঁয়াজের বাজার রীতিমতো বেসামাল। গত ৭-৮ মাস ধরে আলুর কেজি ৫০ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে ছিল। এখন সেটি আরও বেড়ে হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। আর তিন-চার মাস ধরে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। এখন সেটি বেড়ে হয়ে গেছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। আলু-পেঁয়াজের বাজার এখন এতটাই টালমাটাল যে, পণ্য দুটি কিনতে গিয়ে ক্রেতার চোখে পানি চলে আসছে। বিশেষ করে পেঁয়াজের ঝঁজে নাকাল হচ্ছে ক্রেতা। এভাবে বাড়তে বাড়তে পণ্য দুটির দাম কোথায় গিয়ে ঠেকে তা ভেবেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন ক্রেতা। আর বিক্রেতারা বলছেন, যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে তাতে সামনে পেঁয়াজ-আলুর জন্য অশনিসংকেত রয়েছে। অথচ দেশে পণ্য দুটির উৎপাদন হয়েছে বাৎসরিক চাহিদার চেয়েও বেশি। অর্থাৎ বাজারে আলু-পেঁয়াজের কোনো কমতি নেই, তবুও দাম বেড়েই চলেছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পণ্যের ঘাটতির জন্য নয়-আলু-পেঁয়াজের দাম বাড়ছে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে। আলুর দাম বাড়ছে হিমাগার মালিক ও মজুদদারদের কারণে। তারা হিমাগারভর্তি আলু রেখে বাজারে ছাড়ছেন কম এবং চড়া দাম ছাড়া বিক্রি করছেন না। আর পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখছেন পাবনা-সিরাজগঞ্জ ও ফরিদপুরকেন্দ্রিক ফড়িয়াদের সিন্ডিকেটের কারণে। এসব এলাকার মোকাম থেকেই প্রতিদিন দাম বাড়াচ্ছেন তারা। এমনটিই জানিয়েছেন ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩০ থেকে ৩২ লাখ টন। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৭ লাখ ৮৯ হাজার ৮৮৭ টন। তার আগের বছর পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ৩৫ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদার চেয়েও দেশে এখন বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে। সে হিসাবে বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। তবে পচনশীল পণ্য হওয়ায় মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের মধ্যে ৭ থেকে ৮ লাখ টন নষ্ট হয়ে যায়। তবে নষ্ট হওয়ায় পেঁয়াজের সমপরিমাণ আবার আমদানি করা হয় ভারত-চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। সুতরাং চাহিদার চেয়েও বেশি আলু-পেঁয়াজ থাকার পরও দাম বেড়েই চলেছে পণ্য দুটির।

এ বিষয়ে বাজার বিশ্লেষক ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘আলু-পেঁয়াজের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে আমি খুবই শঙ্কিত।ব্যবসায়ীরা কোনো কারণ ছাড়াই গত এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতি কেজি পেঁয়াজে দাম বাড়িয়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আমাদের তথ্য মতে, দশ দিন আগেও দেশের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের কেজি ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা। অথচ এখন দাম বেড়ে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা হয়ে গেছে। এই এক সপ্তাহে পেঁয়াজের বাজারে কি এমন ঘটল যে এভাবে দাম বেড়ে যাবে। আসলে পণ্যের ঘাটতি বা অন্য কোনো কারণে নয়-আলু-পেঁয়াজের দাম বাড়ছে শুধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে। তা ছাড়া বাজারে তো এখন কোনো জবাবদিহিতা নেই। যে যার ইচ্ছেমতো দাম হাঁকিয়ে ক্রেতার পকেট কাটছে। এভাবে ফ্রিস্টাইলে কতদিন বাজার চলবে সেটিই আমার প্রশ্ন।’

রাজধানীর অন্যতম পাইকারি পেঁয়াজের বাজার শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের পেঁয়াজের দাম কমবে না বাড়বে-সেটি নির্ভর করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও ফরিদপুরের ফড়িয়াদের মর্জির ওপর। কারণ দেশের বৃহত্তম পেঁয়াজের মোকাম এই তিন জেলায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই তিন জেলার মোকামে গত এক সপ্তাহে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এখন এসব এলাকায় বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়।

পাবনার সুজানগরের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সময়ের আলোকে বলেন, ‘প্রতি বছরই জুলাই মাস থেকে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরে গিয়ে দাম আরও বেড়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এর কারণ হলো মার্চ মাস নাগাদ দেশে যে পেঁয়াজ উঠেছে তার মজুদ ফুরিয়ে আসছে। এ সময় যদি ভারত থেকে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আমদানি করা যেত তা হলে দাম বাড়ত না। এবার আমদানি কম হচ্ছে। মূলত এ কারণেই দাম বাড়ছে পেঁয়াজের।’

আর শ্যামবাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী জননী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম সময়ের আলোকে বলেন, ‘এ সময় থেকে পেঁয়াজের ঘাটতি শুরু হয় ঠিক আছে, কিন্তু এবার দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে এবং এবারের পেঁয়াজের মানও ভালো। তাই এবার এত তাড়াতাড়ি সংকট হওয়ার কথা না। তবুও সংকট তৈরি হয়েছে ওই পেঁয়াজ উৎপাদনকারী তিন জেলার যারা মজুদদার রয়েছে তাদের কারণে। আমরা সেখানে পেঁয়াজ আনতে গেলে তারা চড়া দাম ধরে বসে থাকছে-বলছে নিলে নেন, না নিলে চলে যান-ক্রেতার অভাব নেই। মূলত তারা চড়া দাম ধরে রাখার কারণেই বাজারটা আরও বেসামাল হয়ে পড়ছে।’

দেশের কৃষকদের ঘরেও এবার পেঁয়াজের মজুদ কমে এসেছে। কারণ, দেশের বাজারে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই পেঁয়াজের দাম অস্থিতিশীল। সাধারণত প্রতি বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত মূল মৌসুমের পেঁয়াজ বা হালি পেঁয়াজ তোলেন কৃষক। এ বছর ওই সময়ও পেঁয়াজের দাম বেশি ছিল। যে কারণে দাম বেশি থাকায় আগেভাগেই উত্তোলন করে বিক্রি করেছিলেন চাষিরা। এতে তারা লাভবান হলেও সার্বিকভাবে দেশের মোট উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। এখন পেঁয়াজের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে মজুদদারদের হাতে।

এদিকে ওই সময় ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিল। যেকোনো সময় সেটি প্রত্যাহার হলে দাম পড়ে যাওয়ার শঙ্কায়ও অনেকে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বাজার তথ্য বলছে, গত মার্চ-এপ্রিলে পেঁয়াজের দাম ছিল যেকোনো বছরের ভরা মৌসুমের চেয়ে বেশি। এভাবে বাড়তে থাকলে পেঁয়াজের কেজি অল্প দিনেই ২০০ টাকার কাছে যাবে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

আলুর বাজার হিমাগার মালিক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাতে : বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বছরে আলুর চাহিদা ৯৫ থেকে ৯৬ লাখ টন। অথচ কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্য মতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩৬ টন। আর গত অর্থবছরে বা ২০২২-২৩ দেশে আলু উৎপাদিত হয় ১ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার টন। যদিও এই হিসাব বলছে আগের বছরের চেয়ে গত বিদায়ি বছরটিতে আলুর উৎপাদন কিছুটা কমেছে, তবে তা চাহিদার চেয়েও অনেক বেশি। চাহিদার চেয়েও দেশে আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা ১০ থেকে ১২ লাখ টন। আর পেঁয়াজের মতো আলু অতটা পচনশীল নয় যে, অনেক আলু নষ্ট হয়ে যাবে। তা হলে এত আলু উৎপাদনের পরও দাম কেন বাড়ছে।

এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকের কাছ থেকে আলু হিমাগারে যাওয়ার পরই আলু হিমাগার মালিকের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তাদের ইচ্ছে-মর্জির ওপর নির্ভর করে আলুর দাম বাড়া-কমা। এ ছাড়া বিগত কয়েক বছরে আলু ব্যবসায় নেমেছেন একশ্রেণির লোক যারা প্রকৃত অর্থে ব্যবসায়ী নন। তাদের মধ্যে আছেন যেমন আছেন সরকারি কর্মকর্তা, তেমনি আছেন রাজনৈতিক নেতাও। সম্প্রতি ভোক্তা অধিদফতরের তদন্তে এমন তথ্যই উঠে আসে। আলুর বাজার এখন এই দুই শ্রেণির লোকই নিয়ন্ত্রণ করছে।

কারওয়ান বাজারে বিগত ২২ বছর ধরে আলু ব্যবসা করা আনোয়ারুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, ‘হিমাগারে এখন আলু আনতে গেলে হিমাগার মালিকরা জোট বেঁধে চড়া দাম হাঁকছেন। তারা বলছে নিলে নেন, না নিলে চলে যান। আমাদের আলু হিমাগারেই থাক। কিন্তু তারা এটিও ভালোই জানেন বাজারে চাহিদা আছে প্রচুর, আলু আমরা কিনবই। তাই তারা বেশি দাম ছাড়া আলু ছাড়ছেন না। আলুর দাম বৃদ্ধির এটিই মূল কারণ। এ ছাড়া দেশে আলুর কোনো কমতি নেই।

আর গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) দেশে আলু উৎপাদিত হয় ১ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার টন; অর্থাৎ এক বছরে উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার টন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে দেশে আলুর চাহিদা ছিল ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার টন। সেই হিসাবে দেশে চাহিদার বিপরীতে ১৬ লাখ টনের মতো উদ্বৃত্ত হওয়ার কথা।

নাগরিক প্রতিবেদন

১১ জুলাই, ২০২৪,  2:15 PM

news image

দেশে আলু-পেঁয়াজের বাজার রীতিমতো বেসামাল। গত ৭-৮ মাস ধরে আলুর কেজি ৫০ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে ছিল। এখন সেটি আরও বেড়ে হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। আর তিন-চার মাস ধরে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। এখন সেটি বেড়ে হয়ে গেছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। আলু-পেঁয়াজের বাজার এখন এতটাই টালমাটাল যে, পণ্য দুটি কিনতে গিয়ে ক্রেতার চোখে পানি চলে আসছে। বিশেষ করে পেঁয়াজের ঝঁজে নাকাল হচ্ছে ক্রেতা। এভাবে বাড়তে বাড়তে পণ্য দুটির দাম কোথায় গিয়ে ঠেকে তা ভেবেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন ক্রেতা। আর বিক্রেতারা বলছেন, যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে তাতে সামনে পেঁয়াজ-আলুর জন্য অশনিসংকেত রয়েছে। অথচ দেশে পণ্য দুটির উৎপাদন হয়েছে বাৎসরিক চাহিদার চেয়েও বেশি। অর্থাৎ বাজারে আলু-পেঁয়াজের কোনো কমতি নেই, তবুও দাম বেড়েই চলেছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পণ্যের ঘাটতির জন্য নয়-আলু-পেঁয়াজের দাম বাড়ছে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে। আলুর দাম বাড়ছে হিমাগার মালিক ও মজুদদারদের কারণে। তারা হিমাগারভর্তি আলু রেখে বাজারে ছাড়ছেন কম এবং চড়া দাম ছাড়া বিক্রি করছেন না। আর পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখছেন পাবনা-সিরাজগঞ্জ ও ফরিদপুরকেন্দ্রিক ফড়িয়াদের সিন্ডিকেটের কারণে। এসব এলাকার মোকাম থেকেই প্রতিদিন দাম বাড়াচ্ছেন তারা। এমনটিই জানিয়েছেন ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩০ থেকে ৩২ লাখ টন। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৭ লাখ ৮৯ হাজার ৮৮৭ টন। তার আগের বছর পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ৩৫ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদার চেয়েও দেশে এখন বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে। সে হিসাবে বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। তবে পচনশীল পণ্য হওয়ায় মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের মধ্যে ৭ থেকে ৮ লাখ টন নষ্ট হয়ে যায়। তবে নষ্ট হওয়ায় পেঁয়াজের সমপরিমাণ আবার আমদানি করা হয় ভারত-চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। সুতরাং চাহিদার চেয়েও বেশি আলু-পেঁয়াজ থাকার পরও দাম বেড়েই চলেছে পণ্য দুটির।

এ বিষয়ে বাজার বিশ্লেষক ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘আলু-পেঁয়াজের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে আমি খুবই শঙ্কিত।ব্যবসায়ীরা কোনো কারণ ছাড়াই গত এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতি কেজি পেঁয়াজে দাম বাড়িয়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আমাদের তথ্য মতে, দশ দিন আগেও দেশের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের কেজি ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা। অথচ এখন দাম বেড়ে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা হয়ে গেছে। এই এক সপ্তাহে পেঁয়াজের বাজারে কি এমন ঘটল যে এভাবে দাম বেড়ে যাবে। আসলে পণ্যের ঘাটতি বা অন্য কোনো কারণে নয়-আলু-পেঁয়াজের দাম বাড়ছে শুধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে। তা ছাড়া বাজারে তো এখন কোনো জবাবদিহিতা নেই। যে যার ইচ্ছেমতো দাম হাঁকিয়ে ক্রেতার পকেট কাটছে। এভাবে ফ্রিস্টাইলে কতদিন বাজার চলবে সেটিই আমার প্রশ্ন।’

রাজধানীর অন্যতম পাইকারি পেঁয়াজের বাজার শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের পেঁয়াজের দাম কমবে না বাড়বে-সেটি নির্ভর করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও ফরিদপুরের ফড়িয়াদের মর্জির ওপর। কারণ দেশের বৃহত্তম পেঁয়াজের মোকাম এই তিন জেলায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই তিন জেলার মোকামে গত এক সপ্তাহে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এখন এসব এলাকায় বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়।

পাবনার সুজানগরের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সময়ের আলোকে বলেন, ‘প্রতি বছরই জুলাই মাস থেকে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরে গিয়ে দাম আরও বেড়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এর কারণ হলো মার্চ মাস নাগাদ দেশে যে পেঁয়াজ উঠেছে তার মজুদ ফুরিয়ে আসছে। এ সময় যদি ভারত থেকে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আমদানি করা যেত তা হলে দাম বাড়ত না। এবার আমদানি কম হচ্ছে। মূলত এ কারণেই দাম বাড়ছে পেঁয়াজের।’

আর শ্যামবাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী জননী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম সময়ের আলোকে বলেন, ‘এ সময় থেকে পেঁয়াজের ঘাটতি শুরু হয় ঠিক আছে, কিন্তু এবার দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে এবং এবারের পেঁয়াজের মানও ভালো। তাই এবার এত তাড়াতাড়ি সংকট হওয়ার কথা না। তবুও সংকট তৈরি হয়েছে ওই পেঁয়াজ উৎপাদনকারী তিন জেলার যারা মজুদদার রয়েছে তাদের কারণে। আমরা সেখানে পেঁয়াজ আনতে গেলে তারা চড়া দাম ধরে বসে থাকছে-বলছে নিলে নেন, না নিলে চলে যান-ক্রেতার অভাব নেই। মূলত তারা চড়া দাম ধরে রাখার কারণেই বাজারটা আরও বেসামাল হয়ে পড়ছে।’

দেশের কৃষকদের ঘরেও এবার পেঁয়াজের মজুদ কমে এসেছে। কারণ, দেশের বাজারে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই পেঁয়াজের দাম অস্থিতিশীল। সাধারণত প্রতি বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত মূল মৌসুমের পেঁয়াজ বা হালি পেঁয়াজ তোলেন কৃষক। এ বছর ওই সময়ও পেঁয়াজের দাম বেশি ছিল। যে কারণে দাম বেশি থাকায় আগেভাগেই উত্তোলন করে বিক্রি করেছিলেন চাষিরা। এতে তারা লাভবান হলেও সার্বিকভাবে দেশের মোট উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। এখন পেঁয়াজের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে মজুদদারদের হাতে।

এদিকে ওই সময় ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিল। যেকোনো সময় সেটি প্রত্যাহার হলে দাম পড়ে যাওয়ার শঙ্কায়ও অনেকে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বাজার তথ্য বলছে, গত মার্চ-এপ্রিলে পেঁয়াজের দাম ছিল যেকোনো বছরের ভরা মৌসুমের চেয়ে বেশি। এভাবে বাড়তে থাকলে পেঁয়াজের কেজি অল্প দিনেই ২০০ টাকার কাছে যাবে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

আলুর বাজার হিমাগার মালিক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাতে : বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বছরে আলুর চাহিদা ৯৫ থেকে ৯৬ লাখ টন। অথচ কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্য মতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩৬ টন। আর গত অর্থবছরে বা ২০২২-২৩ দেশে আলু উৎপাদিত হয় ১ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার টন। যদিও এই হিসাব বলছে আগের বছরের চেয়ে গত বিদায়ি বছরটিতে আলুর উৎপাদন কিছুটা কমেছে, তবে তা চাহিদার চেয়েও অনেক বেশি। চাহিদার চেয়েও দেশে আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা ১০ থেকে ১২ লাখ টন। আর পেঁয়াজের মতো আলু অতটা পচনশীল নয় যে, অনেক আলু নষ্ট হয়ে যাবে। তা হলে এত আলু উৎপাদনের পরও দাম কেন বাড়ছে।

এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকের কাছ থেকে আলু হিমাগারে যাওয়ার পরই আলু হিমাগার মালিকের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তাদের ইচ্ছে-মর্জির ওপর নির্ভর করে আলুর দাম বাড়া-কমা। এ ছাড়া বিগত কয়েক বছরে আলু ব্যবসায় নেমেছেন একশ্রেণির লোক যারা প্রকৃত অর্থে ব্যবসায়ী নন। তাদের মধ্যে আছেন যেমন আছেন সরকারি কর্মকর্তা, তেমনি আছেন রাজনৈতিক নেতাও। সম্প্রতি ভোক্তা অধিদফতরের তদন্তে এমন তথ্যই উঠে আসে। আলুর বাজার এখন এই দুই শ্রেণির লোকই নিয়ন্ত্রণ করছে।

কারওয়ান বাজারে বিগত ২২ বছর ধরে আলু ব্যবসা করা আনোয়ারুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, ‘হিমাগারে এখন আলু আনতে গেলে হিমাগার মালিকরা জোট বেঁধে চড়া দাম হাঁকছেন। তারা বলছে নিলে নেন, না নিলে চলে যান। আমাদের আলু হিমাগারেই থাক। কিন্তু তারা এটিও ভালোই জানেন বাজারে চাহিদা আছে প্রচুর, আলু আমরা কিনবই। তাই তারা বেশি দাম ছাড়া আলু ছাড়ছেন না। আলুর দাম বৃদ্ধির এটিই মূল কারণ। এ ছাড়া দেশে আলুর কোনো কমতি নেই।

আর গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) দেশে আলু উৎপাদিত হয় ১ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার টন; অর্থাৎ এক বছরে উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার টন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে দেশে আলুর চাহিদা ছিল ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার টন। সেই হিসাবে দেশে চাহিদার বিপরীতে ১৬ লাখ টনের মতো উদ্বৃত্ত হওয়ার কথা।