বাংলা ব্লকেড : জনভোগান্তির একদিন

#
news image

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাঁক নিয়ে একের পর এক বাস আসছে। বাস ভর্তি যাত্রী। বুধবার সময় তখন সকাল সাড়ে ১০টার মতো। বাসগুলো প্রথমে গেল সেগুনবাগিচার দিকে। পরে আবার বাঁক ঘুরে ছুটে চলল। এরপরে যাত্রী নিয়ে আবদুল গনি রোড পর্যন্ত যেতে পেরেছে। অথচ এই বাসগুলোর পল্টন মোড় হয়ে গুলিস্তানে যাওয়ার কথা ছিল। বাসে ওঠা যাত্রীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নেমে গেলেও অনেকে অপেক্ষা করছিলেন যদি বাস ছাড়ে। কিন্তু বাসগুলো বেশিদূর এগুতে পারেনি। বাস থেকে নেমে বেশ কয়েকজন যাত্রী বেশ থমকে গেলেন। কারণ তারা যাবেন সদরঘাটে। তাদের আর যাওয়া হয়েছিল কিনা জানা যায়নি।

দুর্ভোগে পড়া ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও হাজার হাজার মানুষ যে ভোগান্তিতে পড়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে বুধবার সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’- এর ব্যানারে ‘বাংলা ব্লকেডের’ অংশ হিসেবে সারাদেশে এ কর্মসূচি পালিত হয়। আর এই আন্দোলনে প্রায় অচল হয়ে যায় রাজধানী। সড়ক পথের পাশাপাশি রেলপথও থাকে সাড়ে ৫ ঘন্টা বন্ধ। তবে নৌ পথ ছিল স্বাভাবিক। অন্যদিকে সড়ক বন্ধ থাকায় মেট্রো রেলে উপচে পড়া ভিড় হয়। সেখানেও অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

সকাল সাড়ে ১০টা থেকে আন্দোলনকারীরা নিজেদের দাবি আদায়ে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়, এলিফ্যান্ট রোড, শাহবাগ, হাই কোর্টের কাছে মৎস্য ভবন মোড়, হানিফ ফ্লাইওভারের নিমতলী, বাংলা মোটর, ফার্মগেট, আগারগাঁও এবং মহাখালীর আমতলীতসহ বিভিন্ন স্থান অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের মত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগগুলো অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো বন্ধ থাকায় যান চলাচল অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। ফার্মগেটে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নামার মুখেও আটকে দেয় বিক্ষোভকারীরা। এই অবরোধের ঘোষণায় অনেক যানবাহন বের না হওয়ায় বুধবার সকাল থেকেই রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় কম। ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি গুলিস্তান, এয়ারপোর্ট, মহাখালী, রামপুরা, মতিঝিল এবং মোহাম্মদপুরসহ অন্যান্য রুটের বাসও কম দেখা গেছে।


এর ফলে ভোগান্তিতে পড়েন সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ। তাদের চলাচল করতে হয়েছে রিকশায় ও হেঁটে। এই সুযোগে রিকশা ভাড়াও কয়েকগুন বাড়তি গুনতে হয়েছে। আর যাত্রীদের পরিবহনে বাধা দেওয়ায় মোড়ে মোড়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ান যাত্রীরা। ভোগান্তির নানা চিত্র : আন্দোলনকারীরা অ্যাম্বুলেন্স, রোগীর পরিবহন, সংবাদপত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিবহনসহ জরুরি সেবার পরিবহন ছেড়ে দিলেও বাকিদের চলাচল করতে হয়েছে হেঁটে। রাস্তা ধরে হাজারও মানুষ কেউ অফিস শেষে কেউ বা অন্য কাজ শেষে হেঁটে বাসায় ফেরেন। তাদের একজন জামিল হোসেন। ফার্মগেট মনিপুরী পাড়ায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। সময়ের আলোকে বলেন, ফার্মগেট ব্যারিকেড দেওয়ায় খামারবাড়ি পর্যন্ত গাড়ি আটকে আছে। সেখান থেকে শাহবাগ হেঁটে এলাম। কারণ সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত বাস পাবো না।

যাত্রী পরিবহনের জন্য শ্রমিকরা ছিলেন সন্ধ্যার অপেক্ষায়। অ্যাপ ভিত্তিক কার চালকরা অনেকেই যানযটে আটকে ঘন্টার পর ঘন্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সময় কাটান। অ্যাপভিত্তিক কার চালক সুমন মোল্লা বলেন, দুই ঘন্টা হলো সার্ক ফোয়ারার উল্টাপাশের রোডে আটকে আছি। ছাত্ররা যেতে দিচ্ছে না। এখন সন্ধ্যার অপেক্ষায় আছি। সন্ধ্যায় তারা ব্যারিকেড ছাড়লে শান্তিতে গাড়ি চালাতে পারবো।

মোহাম্মদপুর থেকে সবজির ভ্যান নিয়ে এক ঘন্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত মো. জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, মোহাম্মদপুর থেইকা সবজি আইনা বাংলামোটর যাওয়ার রাস্তায় আইটকা আছি এক ঘন্টা হলো। আন্দোলন শেষ না হওন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না যাইতে পারুম। বেশ কয়েকটি বাসের চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাও সকাল থেকে রাস্তায় বাস নামাননি। আছেন সন্ধ্যার অপেক্ষায়। আন্দোলন সন্ধ্যায় শেষ হলে বাস নামাবেন। বসুন্ধরায় ভারতীয় ভিসা সেন্টারে ভিসার আবেদন করে গুলিস্তান ফিরছিলেন মো. কাইয়ুম। ফেরার পথে বাইক নিয়ে আটকা পড়েন কারওয়ান বাজার মোড়ে। তিনি বলেন, সরকার কোটার দাবির সমাধান করলেই হয়। তা না করায় মাঝখান দিয়ে আমাদের ভোগান্তি হচ্ছে কয়েক দিন ধরেই।

গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। বেলা সোয়া ৩টায় শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে গুলিস্তানের উদ্দেশ্যে বের হন। এবং বেলা ৪টায় তারা জিরো পয়েন্টে পৌঁছান। জিরো পয়েন্টে অবরোধটি ৩ ঘন্টা স্থায়ী হয়। এ সময় শাহবাগ, কাকরাইল, সদরঘাট, মতিঝিল এবং যাত্রাবাড়ীগামী সড়কগুলোতে তীব্র যানজট লক্ষ্য করা যায়। বাবুবাজারের সড়কেও একই চিত্রের দেখা মিলে।

এ বিষয়ে সদরঘাটগামী একটি বাস থেকে নামার সময় শাকিল আহমেদ নামে এক যাত্রী সময়ের আলোকে বলেন, হঠাৎ সদরঘাটের ওদিক থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে শিক্ষার্থীরা আসার পর গুলিস্তানে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় আগে থেকেই যানবাহন কম ছিল তবে এ মিছিল আসার পর জিরো পয়েন্টে বাস আটকা পড়ে। আর আমাদের ভোগান্তি শুরু হয়। গুলিস্তান এলাকায় সন্ধ্যার দিকে আটকে পড়া কিছু কিছু বাস ও অন্যান্য যানবাহন ছাড়লেও অধিকাংশ বাস তাদের নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডে পার্কিং করা ছিল।

বেলা ২টা। কেবলমাত্র স্কুল ছুটি হয়েছে। সব শিক্ষার্থীর কাঁধে ব্যাগ। একজন অভিভাবক অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে মৌচাক মার্কেটের বিপরীতে। তিনি যাবেন রামপুরায়। একটা রিকশাও পাচ্ছেন না। অনেক কষ্টে এক রিকশা চালকের দেখা মিললেও, তিনি সাফ জানিয়ে দেন- ওই দিকে রাস্তা বন্ধ। আবার মালিবাগ রেলগেটে কোটা আন্দোলনের বেশ কয়েকজন ছাত্র বসে রয়েছে। যতদূর চোখ যায় কোনও গাড়ি নেই। সবাই যে যার মতো করে হাঁটছেন। সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়ে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। তাদের কাঁধে একদিকে ব্যাগ, আবার অন্যদিকে মাথার ওপর ছিল গনগনে সূর্যের রোদের তাপ।

বাংলামোটরে রাস্তার মাঝখানে এক বয়স্ক নারী জানতে চাইলেন, কী ভাবে তিনি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে যাবেন। তার সেখানে এক রোগী ভর্তি রয়েছে। তিনি কোন পথ দিয়ে হাঁটবেন তারও কোন দিশা পেলেন না। যাকেই জিজ্ঞেস করেন, তিনিই হাঁটা পথের সোজা রাস্তা দেখিয়ে দেন। এক ভ্যানচালক যাবেন মগবাজার। তিনি বেলা ১২ টা থেকে ১টা অবধি বসা। তার ভ্যান ঠাঁসা রডে। রডের কারণে ভ্যান গাড়ি এদিকসেদিক করতেও পারছেন না। আন্দোলনরতদের সঙ্গে বাঁক বিকণ্ডায় জড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু। তিনি শাহবাগে আন্দোলনরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাঁক বিকণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে ডা. জাহানারা আরজু আন্দোলনরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘জামায়াত-শিবির’ বলে আখ্যা দেন।

সাড়ে ৫ ঘন্টা ঢাকায় রেল যোগাযোগ বন্ধ: রাজধানীর কারওয়ান বাজার লেভেল ক্রসিং ও মহাখালী লেভেল ক্রসিংয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ব্যারিকেড দেওয়ায় ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে যাত্রীরা পড়েন চরম ভোগান্তিতে।

রেলসূত্র জানিয়েছে, রেলপথে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেওয়ার কারণে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা থেকে কোনও ট্রেন ছাড়েনি। এ সময় ঢাকামুখি ট্রেনগুলো বিভিন্ন স্টেশনে আটকে থাকায় হাজারো যাত্রী দুর্ভোগে পড়েন।
ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস সময়ের আলোকে বলেন, বেলা ১১টার পরে কারওয়ান বাজারসংলগ্ন লেভেল ক্রসিংয়ে ব্যারিকেড দিয়ে ট্রেন চলাচলে বাধা দেন শিক্ষার্থীরা। এর পর বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রেল চলাচল বন্ধ থাকে। ৫টার পর রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়।

দুর্ভোগ মহাসড়কেও:
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টার দিকে কোটাবিরোধী স্লোগান দিয়ে তারা রাজপথে অবস্থান নেন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা সকাল ১১টা থেকে অবরোধ করে রাখেন বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক। কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ি ক্রসিং এলাকায় অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন।

সদরঘাটে লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক: এদিন সদরঘাটে লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক ছিল বলে জানিয়েছেন সদরঘাট ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমের বার্দিংসারেন এস এম মামুন। তিনি বলেন, সদরঘাটের লঞ্চ চলাচল অন্যদিনের মতোই স্বাভাবিক ছিল। কম বা বেশি বলা যায় না।

নাগরিক প্রতিবেদন

১১ জুলাই, ২০২৪,  1:46 PM

news image

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাঁক নিয়ে একের পর এক বাস আসছে। বাস ভর্তি যাত্রী। বুধবার সময় তখন সকাল সাড়ে ১০টার মতো। বাসগুলো প্রথমে গেল সেগুনবাগিচার দিকে। পরে আবার বাঁক ঘুরে ছুটে চলল। এরপরে যাত্রী নিয়ে আবদুল গনি রোড পর্যন্ত যেতে পেরেছে। অথচ এই বাসগুলোর পল্টন মোড় হয়ে গুলিস্তানে যাওয়ার কথা ছিল। বাসে ওঠা যাত্রীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নেমে গেলেও অনেকে অপেক্ষা করছিলেন যদি বাস ছাড়ে। কিন্তু বাসগুলো বেশিদূর এগুতে পারেনি। বাস থেকে নেমে বেশ কয়েকজন যাত্রী বেশ থমকে গেলেন। কারণ তারা যাবেন সদরঘাটে। তাদের আর যাওয়া হয়েছিল কিনা জানা যায়নি।

দুর্ভোগে পড়া ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও হাজার হাজার মানুষ যে ভোগান্তিতে পড়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে বুধবার সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’- এর ব্যানারে ‘বাংলা ব্লকেডের’ অংশ হিসেবে সারাদেশে এ কর্মসূচি পালিত হয়। আর এই আন্দোলনে প্রায় অচল হয়ে যায় রাজধানী। সড়ক পথের পাশাপাশি রেলপথও থাকে সাড়ে ৫ ঘন্টা বন্ধ। তবে নৌ পথ ছিল স্বাভাবিক। অন্যদিকে সড়ক বন্ধ থাকায় মেট্রো রেলে উপচে পড়া ভিড় হয়। সেখানেও অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

সকাল সাড়ে ১০টা থেকে আন্দোলনকারীরা নিজেদের দাবি আদায়ে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়, এলিফ্যান্ট রোড, শাহবাগ, হাই কোর্টের কাছে মৎস্য ভবন মোড়, হানিফ ফ্লাইওভারের নিমতলী, বাংলা মোটর, ফার্মগেট, আগারগাঁও এবং মহাখালীর আমতলীতসহ বিভিন্ন স্থান অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের মত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগগুলো অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো বন্ধ থাকায় যান চলাচল অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। ফার্মগেটে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নামার মুখেও আটকে দেয় বিক্ষোভকারীরা। এই অবরোধের ঘোষণায় অনেক যানবাহন বের না হওয়ায় বুধবার সকাল থেকেই রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় কম। ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি গুলিস্তান, এয়ারপোর্ট, মহাখালী, রামপুরা, মতিঝিল এবং মোহাম্মদপুরসহ অন্যান্য রুটের বাসও কম দেখা গেছে।


এর ফলে ভোগান্তিতে পড়েন সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ। তাদের চলাচল করতে হয়েছে রিকশায় ও হেঁটে। এই সুযোগে রিকশা ভাড়াও কয়েকগুন বাড়তি গুনতে হয়েছে। আর যাত্রীদের পরিবহনে বাধা দেওয়ায় মোড়ে মোড়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ান যাত্রীরা। ভোগান্তির নানা চিত্র : আন্দোলনকারীরা অ্যাম্বুলেন্স, রোগীর পরিবহন, সংবাদপত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিবহনসহ জরুরি সেবার পরিবহন ছেড়ে দিলেও বাকিদের চলাচল করতে হয়েছে হেঁটে। রাস্তা ধরে হাজারও মানুষ কেউ অফিস শেষে কেউ বা অন্য কাজ শেষে হেঁটে বাসায় ফেরেন। তাদের একজন জামিল হোসেন। ফার্মগেট মনিপুরী পাড়ায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। সময়ের আলোকে বলেন, ফার্মগেট ব্যারিকেড দেওয়ায় খামারবাড়ি পর্যন্ত গাড়ি আটকে আছে। সেখান থেকে শাহবাগ হেঁটে এলাম। কারণ সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত বাস পাবো না।

যাত্রী পরিবহনের জন্য শ্রমিকরা ছিলেন সন্ধ্যার অপেক্ষায়। অ্যাপ ভিত্তিক কার চালকরা অনেকেই যানযটে আটকে ঘন্টার পর ঘন্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সময় কাটান। অ্যাপভিত্তিক কার চালক সুমন মোল্লা বলেন, দুই ঘন্টা হলো সার্ক ফোয়ারার উল্টাপাশের রোডে আটকে আছি। ছাত্ররা যেতে দিচ্ছে না। এখন সন্ধ্যার অপেক্ষায় আছি। সন্ধ্যায় তারা ব্যারিকেড ছাড়লে শান্তিতে গাড়ি চালাতে পারবো।

মোহাম্মদপুর থেকে সবজির ভ্যান নিয়ে এক ঘন্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত মো. জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, মোহাম্মদপুর থেইকা সবজি আইনা বাংলামোটর যাওয়ার রাস্তায় আইটকা আছি এক ঘন্টা হলো। আন্দোলন শেষ না হওন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না যাইতে পারুম। বেশ কয়েকটি বাসের চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাও সকাল থেকে রাস্তায় বাস নামাননি। আছেন সন্ধ্যার অপেক্ষায়। আন্দোলন সন্ধ্যায় শেষ হলে বাস নামাবেন। বসুন্ধরায় ভারতীয় ভিসা সেন্টারে ভিসার আবেদন করে গুলিস্তান ফিরছিলেন মো. কাইয়ুম। ফেরার পথে বাইক নিয়ে আটকা পড়েন কারওয়ান বাজার মোড়ে। তিনি বলেন, সরকার কোটার দাবির সমাধান করলেই হয়। তা না করায় মাঝখান দিয়ে আমাদের ভোগান্তি হচ্ছে কয়েক দিন ধরেই।

গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। বেলা সোয়া ৩টায় শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে গুলিস্তানের উদ্দেশ্যে বের হন। এবং বেলা ৪টায় তারা জিরো পয়েন্টে পৌঁছান। জিরো পয়েন্টে অবরোধটি ৩ ঘন্টা স্থায়ী হয়। এ সময় শাহবাগ, কাকরাইল, সদরঘাট, মতিঝিল এবং যাত্রাবাড়ীগামী সড়কগুলোতে তীব্র যানজট লক্ষ্য করা যায়। বাবুবাজারের সড়কেও একই চিত্রের দেখা মিলে।

এ বিষয়ে সদরঘাটগামী একটি বাস থেকে নামার সময় শাকিল আহমেদ নামে এক যাত্রী সময়ের আলোকে বলেন, হঠাৎ সদরঘাটের ওদিক থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে শিক্ষার্থীরা আসার পর গুলিস্তানে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় আগে থেকেই যানবাহন কম ছিল তবে এ মিছিল আসার পর জিরো পয়েন্টে বাস আটকা পড়ে। আর আমাদের ভোগান্তি শুরু হয়। গুলিস্তান এলাকায় সন্ধ্যার দিকে আটকে পড়া কিছু কিছু বাস ও অন্যান্য যানবাহন ছাড়লেও অধিকাংশ বাস তাদের নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডে পার্কিং করা ছিল।

বেলা ২টা। কেবলমাত্র স্কুল ছুটি হয়েছে। সব শিক্ষার্থীর কাঁধে ব্যাগ। একজন অভিভাবক অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে মৌচাক মার্কেটের বিপরীতে। তিনি যাবেন রামপুরায়। একটা রিকশাও পাচ্ছেন না। অনেক কষ্টে এক রিকশা চালকের দেখা মিললেও, তিনি সাফ জানিয়ে দেন- ওই দিকে রাস্তা বন্ধ। আবার মালিবাগ রেলগেটে কোটা আন্দোলনের বেশ কয়েকজন ছাত্র বসে রয়েছে। যতদূর চোখ যায় কোনও গাড়ি নেই। সবাই যে যার মতো করে হাঁটছেন। সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়ে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। তাদের কাঁধে একদিকে ব্যাগ, আবার অন্যদিকে মাথার ওপর ছিল গনগনে সূর্যের রোদের তাপ।

বাংলামোটরে রাস্তার মাঝখানে এক বয়স্ক নারী জানতে চাইলেন, কী ভাবে তিনি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে যাবেন। তার সেখানে এক রোগী ভর্তি রয়েছে। তিনি কোন পথ দিয়ে হাঁটবেন তারও কোন দিশা পেলেন না। যাকেই জিজ্ঞেস করেন, তিনিই হাঁটা পথের সোজা রাস্তা দেখিয়ে দেন। এক ভ্যানচালক যাবেন মগবাজার। তিনি বেলা ১২ টা থেকে ১টা অবধি বসা। তার ভ্যান ঠাঁসা রডে। রডের কারণে ভ্যান গাড়ি এদিকসেদিক করতেও পারছেন না। আন্দোলনরতদের সঙ্গে বাঁক বিকণ্ডায় জড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু। তিনি শাহবাগে আন্দোলনরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাঁক বিকণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে ডা. জাহানারা আরজু আন্দোলনরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘জামায়াত-শিবির’ বলে আখ্যা দেন।

সাড়ে ৫ ঘন্টা ঢাকায় রেল যোগাযোগ বন্ধ: রাজধানীর কারওয়ান বাজার লেভেল ক্রসিং ও মহাখালী লেভেল ক্রসিংয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ব্যারিকেড দেওয়ায় ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে যাত্রীরা পড়েন চরম ভোগান্তিতে।

রেলসূত্র জানিয়েছে, রেলপথে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেওয়ার কারণে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা থেকে কোনও ট্রেন ছাড়েনি। এ সময় ঢাকামুখি ট্রেনগুলো বিভিন্ন স্টেশনে আটকে থাকায় হাজারো যাত্রী দুর্ভোগে পড়েন।
ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস সময়ের আলোকে বলেন, বেলা ১১টার পরে কারওয়ান বাজারসংলগ্ন লেভেল ক্রসিংয়ে ব্যারিকেড দিয়ে ট্রেন চলাচলে বাধা দেন শিক্ষার্থীরা। এর পর বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রেল চলাচল বন্ধ থাকে। ৫টার পর রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়।

দুর্ভোগ মহাসড়কেও:
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টার দিকে কোটাবিরোধী স্লোগান দিয়ে তারা রাজপথে অবস্থান নেন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা সকাল ১১টা থেকে অবরোধ করে রাখেন বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক। কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ি ক্রসিং এলাকায় অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন।

সদরঘাটে লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক: এদিন সদরঘাটে লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক ছিল বলে জানিয়েছেন সদরঘাট ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমের বার্দিংসারেন এস এম মামুন। তিনি বলেন, সদরঘাটের লঞ্চ চলাচল অন্যদিনের মতোই স্বাভাবিক ছিল। কম বা বেশি বলা যায় না।