কর্ম স্থলেই বেড়ে চলেছে শ্রমিকের মৃত্যু মিছিল

#
news image

আজ মহান মে দিবস। শ্রমিকের অধিকার আদায়ের দিন। কিন্তু দেশের শ্রমিক শ্রেণি বা শ্রমজীবী মানুষ তার অধিকার কতটা পাচ্ছে বা কর্মস্থল তার জন্য কতটা নিরাপদ। তথ্য বলছে, পদে পদে শুধু অধিকার ক্ষুন্নই নয়; কর্মস্থলেই দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হচ্ছে শ্রমিককে। কর্মস্থলে অনেককেই আবার শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকারও হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, গত ৯ বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে ৭ হাজার ৬২৪ শ্রমিক, আহত হয়েছে ৫ হাজার ৩৩২ জন। আর গত বছর ২০২৩ সালে কর্মস্থলে মৃত্যু হয়েছে ৭৪২ জনের, আহত হয়েছে ৪৮৯ জন। বছর দশেক আগেও কর্মস্থলে সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হতো গার্মেন্টস খাতে।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কর্মরত অবস্থায় বেশি মারা যাচ্ছে পরিবহন খাতের শ্রমিক। গত ৯ বছরে ৩ হাজার ১৯২ পরিবহনের শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। শুধু যে কর্মক্ষেত্রে মারা যাচ্ছে শ্রমিক, তা নয়। কর্মক্ষেত্রে আসা-যাওয়ার সময়ও ঝরছে শ্রমিকের প্রাণ। ২০১৩ সালে সাভারের ভয়াবহ রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ব্যাপক সংস্কারের ফলে গার্মেন্টস খাতে কমে এসেছে দুর্ঘটনা ও শ্রমিক মৃত্যুর হার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা রোধে নেই কার্যকর উদ্যোগ, নেই আইনের প্রয়োগ, মেলে না ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ। আর এসব কারণেই কর্মস্থলে শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে।

এ বিষয়ে শ্রম খাত বিশেষজ্ঞ ও বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য মালিক বা সরকার-কোনো পক্ষেরই কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। দুর্ঘটনায় শ্রমিক মারা গেলে বিচার মেলে না, এ ক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগও নেই। নিহত-আহত শ্রমিক বা শ্রমিক পরিবার পান না যথাযথ ক্ষতিপূরণ, যা দেওয়া হয়-তা নামমাত্র। সুতরাং যেখানে বিচার মেলে না, ক্ষতিপূরণ দেওয়া লাগে না, আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই সেখানে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা রোধ বা শ্রমিকের মৃত্যু কীভাবে ঠেকানো যাবে। সুতরাং কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে আইনের সংস্কার দরকার, আইন প্রয়োগে কড়াকড়ি করতে হব এবং দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

পরিবহন খাতে মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে সৈয়দ সুলতান বলেন, পরিবহন খাতের শ্রমিকদের জীবনটা আরও কঠিন। কোনো সড়ক দুর্ঘটনায় চালক বা হেলপার হতাহত হলে সবার আগে পরিবহন শ্রমিককেই দায়ী করা হয়। অথচ অনেক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখা যায়, চালকের দায় কম থাকে। অথচ পরিবহন শ্রমিক মারা গেলেও তার নিস্তার থাকে না। এ ছাড়া নিহত শ্রমিক পরিবার ক্ষতিপূরণও পায় না। উল্টো শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের পালিয়ে বেড়াতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। পরিবহন খাতের দুর্ঘটনা কমাতে হলে ও শ্রমিক মৃত্যুর হার কমাতে হলে গার্মেন্টস খাতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। গার্মেন্টস খাতের মতো পরিবহন খাতেও ব্যাপক সংস্কার করতে হবে।

বিলসের জরিপ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০২৩ সালে কর্মক্ষেত্রে নানা রকম দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৭৪২ জন শ্রমিকের। এর মধ্যে শুধু পরিবহন খাতেই মারা গেছে ২৬৯ জন, যা মোট মৃত্যুর ৩৬ শতাংশ। এরপর গত বছর নির্মাণ খাতে নিহত হয়েছে ১১৮ জন, কৃষি খাতে ৯৭ জন, রিকশাশ্রমিক ৪৪ জন, প্রবাসী শ্রমিক ৩৫ জন, দিনমজুর ৩০ জন, মৎস্য শ্রমিক ২৭ জন, বিদ্যুৎ শ্রমিক ১৬ জন, নৌপরিবহন শ্রমিক ১৫ জন, স্টিল মিল শ্রমিক ১১ জন এবং অন্যান্য খাতের ৮০ জন। এ ছাড়া গত বছর কর্মক্ষেত্রে আহত হয়েছেন মোট ৪৮৯ জন শ্রমিক। বিলসের জরিপ তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ২০১৫ সাল থেকে ২০২৩ সালÑএই ৯ বছরে কর্মস্থলে মৃত্যু হয়েছে ৭ হাজার ৬২৪ জন শ্রমিকের। এর মধ্যে ২০১৫ সালে মৃত্যু হয় ৩৬৩ জনের, ২০১৬ সালে ৬৯৯ জনের, ২০১৭ সালে ৭৮৪ জনের, ২০১৮ সালে ১ হাজার ২০ জনের, ২০১৯ সালে ১ হাজার ২০০ জনের, ২০২০ সালে ৭২৯ জনের, ২০২১ সালে ১ হাজার ৫৩ জনের, ২০২২ সালে ১ হাজার ৩৪ জনের এবং ২০২৩ সালে কর্মস্থলে মৃত্যু হয়েছে ৭৪২ জনের। এ ছাড়া গত ৯ বছরে কর্মস্থলে আহত হয়েছে ৫ হাজার ৩৩২ জন।

বিলসের তথ্য বলছে, শ্রমজীবী মানুষ যে শুধু কর্মস্থলেই মৃত্যুবরণ করছে তা না, কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার পথেও নানা দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে বা আহত হচ্ছে। যেমন সর্বশেষ ২০২৩ সালে কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার পথে মৃত্যু হয়েছে ৪২ জন শ্রমিকের এবং আহত হয়েছে ৩৩ জন।
 বিলসের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে কর্মস্থলে নির্যাতের শিকার হয়েছে ৩০৬ জন শ্রমিক। এর মধ্যে পুরুষ ২৭৮ জন, নারী ২৮ জন। নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৫৭ জনের, আহত হয়েছে ১২৭ জন। এ ছাড়া ১৬ জন হয়েছে নিখোঁজ, ৩ জন নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে এবং ৩ জনকে অপহরণের পর পুলিশ উদ্ধার করে। কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনে মৃত্যু বেশি হয়েছে রিকশাশ্রমিকের, ৬৬ জন। এ ছাড়া পরিবহন খাতের ২১ জন, নিরাপত্তাকর্মী ১৪ জন, গৃহকর্মী ১১ জন, কৃষিশ্রমিক ১০ জন এবং অন্যান্য ৩৫ জন।

নাগরিক প্রতিবেদন

০১ মে, ২০২৪,  3:13 PM

news image

আজ মহান মে দিবস। শ্রমিকের অধিকার আদায়ের দিন। কিন্তু দেশের শ্রমিক শ্রেণি বা শ্রমজীবী মানুষ তার অধিকার কতটা পাচ্ছে বা কর্মস্থল তার জন্য কতটা নিরাপদ। তথ্য বলছে, পদে পদে শুধু অধিকার ক্ষুন্নই নয়; কর্মস্থলেই দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হচ্ছে শ্রমিককে। কর্মস্থলে অনেককেই আবার শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকারও হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, গত ৯ বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে ৭ হাজার ৬২৪ শ্রমিক, আহত হয়েছে ৫ হাজার ৩৩২ জন। আর গত বছর ২০২৩ সালে কর্মস্থলে মৃত্যু হয়েছে ৭৪২ জনের, আহত হয়েছে ৪৮৯ জন। বছর দশেক আগেও কর্মস্থলে সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হতো গার্মেন্টস খাতে।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কর্মরত অবস্থায় বেশি মারা যাচ্ছে পরিবহন খাতের শ্রমিক। গত ৯ বছরে ৩ হাজার ১৯২ পরিবহনের শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। শুধু যে কর্মক্ষেত্রে মারা যাচ্ছে শ্রমিক, তা নয়। কর্মক্ষেত্রে আসা-যাওয়ার সময়ও ঝরছে শ্রমিকের প্রাণ। ২০১৩ সালে সাভারের ভয়াবহ রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ব্যাপক সংস্কারের ফলে গার্মেন্টস খাতে কমে এসেছে দুর্ঘটনা ও শ্রমিক মৃত্যুর হার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা রোধে নেই কার্যকর উদ্যোগ, নেই আইনের প্রয়োগ, মেলে না ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ। আর এসব কারণেই কর্মস্থলে শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে।

এ বিষয়ে শ্রম খাত বিশেষজ্ঞ ও বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য মালিক বা সরকার-কোনো পক্ষেরই কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। দুর্ঘটনায় শ্রমিক মারা গেলে বিচার মেলে না, এ ক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগও নেই। নিহত-আহত শ্রমিক বা শ্রমিক পরিবার পান না যথাযথ ক্ষতিপূরণ, যা দেওয়া হয়-তা নামমাত্র। সুতরাং যেখানে বিচার মেলে না, ক্ষতিপূরণ দেওয়া লাগে না, আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই সেখানে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা রোধ বা শ্রমিকের মৃত্যু কীভাবে ঠেকানো যাবে। সুতরাং কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে আইনের সংস্কার দরকার, আইন প্রয়োগে কড়াকড়ি করতে হব এবং দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

পরিবহন খাতে মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে সৈয়দ সুলতান বলেন, পরিবহন খাতের শ্রমিকদের জীবনটা আরও কঠিন। কোনো সড়ক দুর্ঘটনায় চালক বা হেলপার হতাহত হলে সবার আগে পরিবহন শ্রমিককেই দায়ী করা হয়। অথচ অনেক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখা যায়, চালকের দায় কম থাকে। অথচ পরিবহন শ্রমিক মারা গেলেও তার নিস্তার থাকে না। এ ছাড়া নিহত শ্রমিক পরিবার ক্ষতিপূরণও পায় না। উল্টো শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের পালিয়ে বেড়াতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। পরিবহন খাতের দুর্ঘটনা কমাতে হলে ও শ্রমিক মৃত্যুর হার কমাতে হলে গার্মেন্টস খাতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। গার্মেন্টস খাতের মতো পরিবহন খাতেও ব্যাপক সংস্কার করতে হবে।

বিলসের জরিপ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০২৩ সালে কর্মক্ষেত্রে নানা রকম দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৭৪২ জন শ্রমিকের। এর মধ্যে শুধু পরিবহন খাতেই মারা গেছে ২৬৯ জন, যা মোট মৃত্যুর ৩৬ শতাংশ। এরপর গত বছর নির্মাণ খাতে নিহত হয়েছে ১১৮ জন, কৃষি খাতে ৯৭ জন, রিকশাশ্রমিক ৪৪ জন, প্রবাসী শ্রমিক ৩৫ জন, দিনমজুর ৩০ জন, মৎস্য শ্রমিক ২৭ জন, বিদ্যুৎ শ্রমিক ১৬ জন, নৌপরিবহন শ্রমিক ১৫ জন, স্টিল মিল শ্রমিক ১১ জন এবং অন্যান্য খাতের ৮০ জন। এ ছাড়া গত বছর কর্মক্ষেত্রে আহত হয়েছেন মোট ৪৮৯ জন শ্রমিক। বিলসের জরিপ তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ২০১৫ সাল থেকে ২০২৩ সালÑএই ৯ বছরে কর্মস্থলে মৃত্যু হয়েছে ৭ হাজার ৬২৪ জন শ্রমিকের। এর মধ্যে ২০১৫ সালে মৃত্যু হয় ৩৬৩ জনের, ২০১৬ সালে ৬৯৯ জনের, ২০১৭ সালে ৭৮৪ জনের, ২০১৮ সালে ১ হাজার ২০ জনের, ২০১৯ সালে ১ হাজার ২০০ জনের, ২০২০ সালে ৭২৯ জনের, ২০২১ সালে ১ হাজার ৫৩ জনের, ২০২২ সালে ১ হাজার ৩৪ জনের এবং ২০২৩ সালে কর্মস্থলে মৃত্যু হয়েছে ৭৪২ জনের। এ ছাড়া গত ৯ বছরে কর্মস্থলে আহত হয়েছে ৫ হাজার ৩৩২ জন।

বিলসের তথ্য বলছে, শ্রমজীবী মানুষ যে শুধু কর্মস্থলেই মৃত্যুবরণ করছে তা না, কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার পথেও নানা দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে বা আহত হচ্ছে। যেমন সর্বশেষ ২০২৩ সালে কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার পথে মৃত্যু হয়েছে ৪২ জন শ্রমিকের এবং আহত হয়েছে ৩৩ জন।
 বিলসের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে কর্মস্থলে নির্যাতের শিকার হয়েছে ৩০৬ জন শ্রমিক। এর মধ্যে পুরুষ ২৭৮ জন, নারী ২৮ জন। নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৫৭ জনের, আহত হয়েছে ১২৭ জন। এ ছাড়া ১৬ জন হয়েছে নিখোঁজ, ৩ জন নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে এবং ৩ জনকে অপহরণের পর পুলিশ উদ্ধার করে। কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনে মৃত্যু বেশি হয়েছে রিকশাশ্রমিকের, ৬৬ জন। এ ছাড়া পরিবহন খাতের ২১ জন, নিরাপত্তাকর্মী ১৪ জন, গৃহকর্মী ১১ জন, কৃষিশ্রমিক ১০ জন এবং অন্যান্য ৩৫ জন।